সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৪৫)

কেল্লা নিজামতের পথে
নবাব সিরাজের হঠকারিতা ও অদূরদর্শী চিন্তাভাবনার একটি উদাহরণ দিই। ইংরেজদের চাপে এবং ঘরোয়া কোন্দলে তখন প্রায় ছন্নছাড়া নবাব। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে কাশিমবাজার ফরাসি কুঠির প্রধান ল সাহেবের। ইংরেজরা নবাব ও ফরাসিদের এই সম্পর্ককে ভালোভাবে নেয়নি কোনদিনই। কারণ ফরাসি ও নবাব উভয়েই ইংরেজদের ঘোষিত শত্রু। আর তারমধ্যে ক্লাইভ ধুরন্ধর ও চটুল নেতা। তাই তিনি ফরাসীদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্ক যে তাদের সম্রাজ্যবাদী চিন্তার অনুকূল নয় তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। আর তখন থেকেই ল সাহেবের নামে নবাবের কাছে বিভিন্ন ভাবে কান ভাঙাতে শুরু করে ওয়াটস সাহেব। এদিকে নবাব খুব একটা দৃঢ়চেতা মানুষ নয় কোনদিনই। প্রতি সিদ্ধান্তেই তিনি দোলাচলে পড়েন বারবার। তাই বন্ধু হয়েও ল সাহেবকে অবিশ্বাস করতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। একদিকে ইংরেজ ও অন্যদিকে ফরাসি, এই দ্বৈতশক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নবাব কী করবেন তা বুঝে উঠতেই সময় চলে যায় তাঁর। তাই ধীরে ধীরে ফরাসিদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় নবাবের। এরপর সেই ঠাণ্ডা লড়াইতে জয়ী হয় ইংরেজরাই। কারণ নবাব কে বুঝিয়ে সুুঝিয়ে এবং টাকা দিয়ে ল সাহেবকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত খুব সহজেই ফলপ্রসু হয় মুর্শিদাবাদে। শেষে কাশিমবাজার থেকে ল সাহেব চলে যান পাটনায়। আর সেখানেই মিটে যায় নবাবের সঙ্গে তার সমস্ত দেখা-সাক্ষাৎ ও সুসম্পর্ক। এটি একটি উদাহরণ। একজন নয়, এমন অজস্র মানুষ ধীরে ধীরে দূরে যেতে থাকে নবাবের থেকে। এদিকে তার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং অপরিণমদর্শিতায় বাংলার প্রায় সব হিন্দু জমিদার বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখন বীরভূম ছাড়া প্রায় সমস্ত জায়গাতেই হিন্দু জমিদারদের রাজত্ব। তারা সকলেই নবাবের অধীনস্থ হলেও ক্ষমতার দিক থেকে খুব একটা কম নয়। তাই সকলে মিলে দলবদ্ধ হয়ে নবাবের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ তৈরি করবার চিন্তা ভাবনা ছড়িয়ে পড়ল প্রায় সব দিকেই। এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে নবাবের তখন যাঁতাকলে পড়বার মতো অবস্থা। কোনো দিকেই অনুকূল বলতে প্রায় কিছুই নেই। নবাবের বিরুদ্ধাচরণে যে সকল হিন্দু জমিদাররা অগ্রগণ্য হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারমধ্যে অন্যতম নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম তখন শুধু বাংলায় নয়, ছড়িযয়েছিল তার বাইরেও। প্রজাহিতৈষী জমিদার হিসেবে তিনি সর্বজনপ্রিয়। সেখানে হঠাৎ মুর্শিদাবাদের নবাবের বিরুদ্ধে তিনি খড়্গহস্ত হয়ে উঠবেন কেন, সেই প্রশ্ন আমায় কুরে কুরে খেয়েছে বহুবার। অকারণে অযথা নবাবের পতনের জন্য তিনি সচেষ্ট হবেন, এমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তার কোনদিনই ছিল না। নবাব আলীবর্দির সময়ে তিনি একবার মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে তার প্রতিশোধ নেবেন। কারণ বন্দি থাকার কিছুদিন পরেই নবাব আলীবর্দী সসম্মানে তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন তার তুমুল জনপ্রিয়তার নিরিখেই। তাই নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাথে অনেকে তার বন্দী হওয়ার ঘটনাটিকে জড়িয়ে দিলেও, তা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। তাই নবাবের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান নবাবের নৈরাজ্য এবং অপরিণামদর্শিতার দিকেই আঙুল তুলে দেয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছাড়াও প্রায় সকল হিন্দু জমিদারই নবাবের বিরুদ্ধে যোগদান করেন। কেউ সরাসরি অথবা কেউ পরোক্ষভাবে। নিজের রাজত্বের মধ্যে সব জমিদারদের এই বিরুদ্ধে অবস্থান নবাবকে তীব্র চাপে ফেলে দেয় এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সে যুগের আর্তসামাজিক অবস্থায় এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলার মসনদের জন্য যে এক ঘোরতর সংকট, সে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। নবাব একদিকে স্বৈরাচারী শাসকের মত আচরণ করছেন তার নিজের দরবার থেকে শুরু করে রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে, আর অন্যদিকে একে একে বেড়েই চলেছে তার শত্রুপক্ষের সংখ্যা। তাই মসনদ থেকে সিরাজউদ্দৌলার পতন যে শুধু সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। পলাশীর যুদ্ধ তো এক প্রহসন মাত্র। যুদ্ধের অনেক আগেই নবাবের হার সূচিত হয়ে গেছিল বাংলার প্রতিটি মানুষের মনে। যারা এখন তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে ব্যাখ্যা করেন, তাদেরকে একটি প্রশ্ন করি। বাংলার রাজনৈতিক চিত্রে তখন জাতীয়তাবাদের চিত্রটি ঠিক কেমন ছিল ভেবে দেখেছেন? যে শাসকের কাছে হাজার প্রয়োজনেও সাধারণ মানুষ পৌঁছতে পারে না, যে শাসকের বিচারের প্রহসনে দিনের পর দিন প্রাণ দেয় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ, যে শাসকের শোভাযাত্রা রাস্তায় বেরোলে সাধারণ মানুষকে তার আশপাশেও ঘেঁষতে দেয়া হয় না, সেখানে শাসকের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো অবশ্যই ওঠে। ঠিক তখনই উল্টো চিত্রটি আমরা দেখছি জমিদারদের জমিদার বাড়িগুলোয়। সেখানে অসংখ্য প্রজাদের উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার। তেমন কোন বাধা নেই। বিচারের আশায় দলে দলে সাধারণ মানুষ শরণাপন্ন হন স্থানীয় জমিদারদের দরবারে। তারা নবাবের মসনদ নিয়ে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। এমনকি কবে যে মুর্শিদাবাদের মসনদে নবাব পরিবর্তন হয়ে যায়, সেটুকু তথ্যও সাধারণ মানুষের জানা ছিল না। এ হেন পরিস্থিতিতে এমন জনবিচ্ছিন্ন এক নবাব কতদিনই বা নিজের সুশাসন বজায় রেখে চলতে পারেন?
আজকের মুর্শিদাবাদ এইসব প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। সেখানে পথঘাট অলি গলিতে আজও প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খায়। এত অন্তর্ঘাত, এত প্রতিশোধস্পৃহা, এত চক্রান্তকে সাক্ষী করে আসলে কেমন ছিল মুর্শিদাবাদ? নবাবের মৃত্যুকে যখন আমরা ‘অস্তমিত স্বাধীনতার শেষ সূর্য’ বলে উল্লেখ করি, তখন কি ভেবে দেখি যে নবাবী আমলে বাংলার স্বাধীনতার কি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি? এইসব দিক বিচার করলেই বোঝা যায়, কেন ক্লাইভের নেতৃত্বে সারা বাংলা একত্রিত হয়েছিল ওই একজন নবাবের বিরুদ্ধে। শুধু একেবারে নিচ থেকে হঠাৎ তুলে আনা কিছু কর্মচারীকে ছেড়ে বাকি সমস্ত আমির ওমরাহ ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রায় সকলে তখন নবাবের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং নবাবকে গতিচ্যুত করতে সর্বসম্মতভাবে ক্লাইভকে নেতা নির্বাচন করে একযোগে। কারণ এটুকু অন্তত সবাই বুঝেছিল, যে নবাবকে মসনদ থেকে নামাতে হলে একমাত্র প্রয়োজন ব্রিটিশদেরই।