কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৫

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র
ইশা খাঁয়ের পিতা কালিদাস গজদানির মুসলমান হওয়ার গল্পটা বেশ আকর্ষণীয়। শোনা যায় কোন এক সময় এক মুসলমান ফকিরের সাথে তর্কযুদ্ধে হেরে তাকে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়। আর তারপর থেকে এই রাজপুত হিন্দু সম্পূর্ণ একজন মুসলমান বংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন তার নাম হয়ে সোলাইমান খান। বাংলার ভাটি অঞ্চলে তার প্রবল আধিপত্য ছিলই। আর সেই সময় দিল্লিতে ঘটেছিল ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন। ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করে শের শাহের মৃত্যু হয় এবং সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ। যদিও তখন অবধি বাংলার ভার দিল্লির হাতে যায়নি। কিন্তু ইসলাম শাহ চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে নিজের আয়ত্তে আনার। তাই সিংহাসনে বসবার পরেই বাংলার জন্য এক একক প্রশাসনিক শৃঙ্খলাপত্র তিনি প্রেরণ করেন। যদিও সোলাইমানের পক্ষে তা মেনে নিতে ভীষণ অসুবিধা ছিল। কারণ তার আগে অবধি বাংলা সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। আর সেই স্বাধীনতাকে বজায় রাখবার জন্য বাংলার শাসকগণ কম কাটখড় পোয়ায়নি৷ তবু সেই সময়ে বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য তাজ খান এবং দরিয়া খান নামে দুই সেনাপতিকে পাঠান ইসলাম শাহ। সোলাইমান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন এবং তার দুই পুত্র ঈশা ও ইসমাইলকে বন্দি করে ইরানী বণিকদের নিকট দাসরূপে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই হল ঈশা খাঁয়ের ছেলেবেলার গল্প। তাই বলা যায় ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন না থাকলে একজন বিক্রি হয়ে যাওয়া ক্রীতদাসের পক্ষে আবার বাংলার সর্বেসর্বা হওয়া কখনোই সম্ভব ছিল না।
মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানরা বারবার ঈশা খাঁয়ের শরণাপন্ন হয়। ইতিহাসে তার একাধিক নিদর্শন আছে। আর মুঘলদের বিরুদ্ধে সেই জন্মশত্রু পাঠানদের সাহায্য করতেও কখনও পিছপা হননি ইশা। ঈশা খাঁয়ের জীবন ছিল যুদ্ধ দিয়ে ভরা। আর মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময়ে আশেপাশের রাজাদের সঙ্গে এবং পাঠানদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে হয়েছিল। ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান জাহান ইশা খাঁয়ের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে তিনি মুঘলদের পরাজিত করবার জন্য ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের সাহায্য প্রার্থনা করেন। আর সেই সময় ত্রিপুরা থেকে বাহিনী নিয়ে এসে তার সঙ্গে যুক্ত হলে মুঘলরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবেই বারংবার ইশার পরাক্রমে পিছিয়ে যেতে হয় মুঘলদের। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইশা খাঁ নিজের শক্তি আরও বৃদ্ধি করেন এবং বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘মসনদ-ঈ-আলা’ হিসাবে ঘোষণা করেন। বাংলায় তাঁর ক্ষমতা তখন মুঘল সম্রাটদের চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ বিভিন্ন সময়ে শক্তিশালী সেনাপতি সমেত সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েও বাংলার এই ভাটি অঞ্চলকে কোনভাবেই আয়ত্তে আনা যাচ্ছিল না মুঘলদের তরফে।
ঠিক এই সময়েই মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা দুই সেনাপতি মাসুম খান কাবুলি এবং কতলু খাঁ এসে যোগ দেন ইশার সঙ্গে। ফলে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নেতৃত্বে সেই ইশা খাঁ। আর ঠিক তারপরেই মুঘলদের যে সেনাপতির কথা না বললে এই কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন শাহবাজ খাঁ। অন্যতম প্রধান শক্তিশালী মুঘল সেনাপতি শাহবাজ ইশা খাঁকে পরাস্ত করতে অগ্রসর হন। এই সময় মুঘল সেনাপতি শাহবাজ খাঁ এবং তারসুন খাঁয়ের সঙ্গে ঈশার দুবার ভয়ানক যুদ্ধ হয়। এবং সেই যুদ্ধেও মুঘল বাহিনী পরাজিত হয়। এইসব যুদ্ধের কাহিনী থেকেই বুঝতে পারা যায় তৎকালীন বাংলার ভাটি অঞ্চলে ঈশা খাঁয়ের ঠিক কতটা ক্ষমতা ছিল। তবে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র শাহবাজ নয়। তাই ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আবার সেনা সংগ্রহ করে ইশা খাঁকে আক্রমণ করে সে। এই সময়ে দিল্লি থেকে সম্রাট আকবর শাহবাজকে সাহায্যের জন্য মানসিংহকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই সৈন্য সংগ্রহের আশ্বাস দেন সম্রাটকে। ফলে এই ঘটনাটি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে শাহবাজ হয়ত বাংলা থেকেই বাঙালি সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন ইশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য। কারন সেই সময় দিল্লি থেকে বাদশার বাহিনী এসে শাহবাজের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। কিন্তু সেবারেও ঢাকা বিক্রমপুর বা সোনারগাঁও অঞ্চলে ভয়াবহ যুদ্ধে শাহবাজ পর্যুদস্ত হয়। ফলে স্বয়ং মানসিংহ দিল্লি থেকে এই বাংলায় পদার্পণ না করলে ঈশা খাঁয়ের ক্ষমতা কোন ভাবে আয়ত্ত করা সম্ভব ছিল কিনা সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরাও সন্দিহান। ১৫৯৪ সালে মানসিংহ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। ফলে মাঝের এই দশ বারো বছর ইশা যে নিশ্চিন্তে বাংলায় রাজ্য শাসন করতেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এই সময়কালটিতে মুঘলদের সঙ্গে তাঁর আর কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। শোনা যায় শাহবাজের সঙ্গে যুদ্ধে ইশা খাঁয়ের বাহিনী অত্যাধুনিক মাস্কেট এবং গানপাউডার আর্টিলারি ব্যবহার করেছিলেন। তৎকালীন যুগে এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার প্রায় চোখেই পড়ত না। সেখানে এই বাংলার একচ্ছত্র নরপতি ঈশা খাঁ যেভাবে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে আশেপাশের সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাতে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের কথা বারবার স্বীকার করতেই হয়।
এইসব ঘটনা বিচার করলে স্পষ্ট দেখা যায় যে বারো ভূঁইয়ার সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ঈশা খাঁয়ের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পরম ক্ষমতাশালী মুঘল সম্রাট আকবর বাংলার শাসন ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নিতে পারেননি। তাঁকেও বারবার পিছিয়ে আসতে হয়েছে বাংলার পরাক্রমশালী শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও। অথচ এই পরাক্রমশালী শাসকদের কথা আমরা যেন একেবারেই ভুলে গেছি। আমাদের এই সোনার বাংলায় যে পরাক্রম তাঁরা একসময় প্রদর্শন করেছিলেন, তা ক্ষমতার ভিত্তিতে পরাক্রমশালী রাজপুত বা মারাঠাদের থেকেও কোন অংশে কম নয়। কিন্তু ইতিহাসবিদের বাংলাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেছেন বারবার। এখানকার স্বাধীন নরপতিদের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বিবেচনা করলে তৎকালীন বাংলার শাসন ব্যবস্থার সঠিক ছবিটি তুলে আনা সম্ভব হয়।