।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় জয়া মজুমদার

অন্য মোনালিসা

মোনালিসা আমার ছোটোবেলার বন্ধু। খুব অল্প বয়সে ওর বিয়ে হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না৷ বারো বছর পর সেদিন শপিং মলে মোনালিসার সাথে দেখা। এত বছর পর ওকে দেখে খুব অবাক হলাম। যাকে বারো বছর আগে দেখেছি আজ তাকেই যে বড়ো অচেনা লাগছে। যে মোনালিসা কখনো সালোয়ার কামিজ আর শাড়ি ছাড়া কিছুই পরতো না, সে আজ জিন্স টিশার্ট পরা। যার কোমড় ছাড়ানো চুল ছিলো আজ সেই চুল কাঁধ অবধি। যাকে কখনো সাজতে দেখেনি আজ তার চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক। বিয়ের পর যে হাতে শাখা পলা ছাড়া কিছু থাকতো না সেই হাতে আজ শুধু ঘড়ি। সিঁথিতে যার চওড়া করে সিঁদুর থাকতো, কপালে সিঁদুরের লাল টিপ থাকতো তার আজ আর কিছুই নেই। খুব অবাক হলাম। মোনালিসা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “খুব অবাক হচ্ছিস না আমাকে দেখে”? উত্তর দিলাম তা হচ্ছি বই কি। তোকে তো আগে কখনো এরকম দেখিনি। তবে বেশ লাগছে তোকে পুরো অন্যরকম। মোনালিসা হেসে আমার কথার উত্তরে বললো পরিস্থিতি মানুষকে পাল্টে দেয়। আমিও সেই পরিস্থিতির স্বীকার। জানতে চাইলাম ওর স্বামীর কথা, বিবাহিত জীবনযাপনের কথা। বললো, সে আছে তার মতো আর আমি আমার মতো। শুনে বুঝলাম কিছু সমস্যা হয়তো আছে। জানতে চাইলো আমার সংসার যাপনের কথা। কিছুক্ষন কথা বলার পর মোনালিসা আমাকে একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো। বললো আজ রাতের ডিনারটা এখানেই করবো। অনেকদিন পর দুজনের দেখা আজ না করিস না। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আর সত্যি তো বারোটা বছর তো কম নয়। দুজনে একটা টেবিলে বসলাম। আমি বললাম তোর সাথে অনেক কথা আছে। মোনালিসা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো আমারও তো আছে অনেক অনেক কথা। আজ সব বলবো কিন্তু একটা কথা আমি কিন্তু মদ খাবো। কথাটা শুনে মনে মনে ভাবলাম কত সহজে এই কথাটা ও বললো। অথচ একসময় এই মদকে কত ঘেন্না করতো। যে জিনিসের প্রতি ওর এতো ঘেন্না ছিলো আজ নাকি সেটা না হলে চলেনা। আমাকেও অফার করলো। আমি না বলাতে সামান্য বিরক্ত হলেও মেনে নিলো। আমি আবারও জানতে চাইলাম ওর স্বামী, সন্তানের কথা।
মোনালিসা হেসে জবাব দিলো, যে স্বামী সাতদিনই সাতটা মেয়ের বিছানায় রাত কাটিয়ে আসে, যে স্বামী কোনোদিন তার স্ত্রীর শরীরকে স্পর্শই করেনি সেই স্ত্রীর কি সন্তান হয়?? কথাটা শুনে আমি চুপ করে রইলাম। মোনালিসা গ্লাসে একটু করে চুমুক দিচ্ছে আর বলছে,
আজ আমার যে এতো পরিবর্তন দেখছিস সবটাই পরিস্থিতির কারনে। বৌ ভাতের রাত থেকে যতদিন স্বামীর কাছে ছিলাম কোনোদিন এতটুকুও তার ভালোবাসা পাইনি। বাবা সম্বন্ধ পেয়ে বিয়ে দিলো ঠিকই কিন্তু ওদের সাথে আমাদের মতোন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মিল হয়না রে কখনো। বৌ ভাতের রাতে সব মেয়েরা যা আশা করে আমিও তাই করেছিলাম। ভেবেছিলাম সবাইকে নিয়ে সুখে ঘরসংসার করবো। কিন্তু মানুষ যা ভাবে সবসময় তা হয় না রে। আমার ভাবনাটাই বৃথা। সে রাতে স্বামীকে কাছে পাওয়ার যে উৎকন্ঠা সব নিমেষে শেষ হয়ে গেলো আমার শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকায়। সেদিন আমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে স্বামীর আদরের দাগের পরিবর্তে শুধুই সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ আর ফোস্কা। শ্বশুর শ্বাশুড়ির গঞ্জনা, দিনের পর দিন স্বামীর অত্যাচার আর অবহেলায় আমি জেরবার হয়ে উঠেছিলাম। উঠতে বসতে শুনতে হতো আমার কোনো যোগ্যতা নেই। সেই মানুষটিও আমাকে জানিয়ে দিলো এমন সাদামাটা গেঁয়ো মেয়েকে বৌ বলে পরিচয় দিতে তার লজ্জা করে। আমার মতো মেয়ের সাথে তাকে কখনোই মানায় না।
আমি একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছি ওর কথাগুলো। একবার করে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে আর বলছে, তোর মনে পরে অমৃতার কথা??আমাদের কলেজে পড়তো। বললাম হ্যাঁ মনে আছে তো। কেন কি হয়েছে ওর??
মোনালিসা বললো, একদিন রাতে অমৃতাকে নিয়ে এসে সোজা বাড়িতে তুললো। জানিয়ে দিলো আজ থেকে অমৃতা এখানেই থাকবে। আমি মেনে নিতে পারলে ভালো নাহলে নিজের রাস্তা নিজেকে দেখে নিতে হবে। সেদিন আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো। সেদিন থেকে আমার ঠাঁই হলো চিলেকোঠার ঘরে আর অমৃতা আমার বিছানার ভাগীদার। মুখ বুজে সব সহ্য করে কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু কতদিন, আর কতদিন মেনে নেবো!!! আমি জানিয়ে দিলাম এভাবে আমি থাকতে পারবো না। উত্তর এলো দরজা খোলা তুমি যেখানে খুশি চলে যেতে পারো।
অগত্যা চলে এলাম বাপের বাড়ি। এখানেও অভাবের সংসার। বাবার সামান্য পেনশনে সংসার চলে। তারওপর বিবাহিত মেয়ে দিনের পর দিন বাপের বাড়িতে থাকলে যা হয়!! পাড়া প্রতিবেশীর নানান কথা সাথে বাবা মার মুখে একটা চিন্তার ছাপ সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যেমন করে হোক একটা কাজ আমাকে জোগাড় করতে হবে। বেরোলাম কাজের সন্ধানে। নানান জায়গায় খোঁজ নিতে লাগলাম। তারমধ্যেই হঠাৎ একদিন সেই মানুষটি যার সাথে দূর্ভাগ্যবশত গাঁটছড়া বেঁধেছিলাম ফোন করলো। জানালো সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। আমিও একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। কোনোদিন যার ভালবাসাই পেলাম না তার ওপর মায়া আর কি হবে!!! অবশেষে একদিন আমাদের ডিভোর্সটাও হয়ে গেলো।
কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হলো অরুণের সাথে। ছেলেটি আমাকে কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি দিলো। একদিন বিকেলে অরুণ আমাকে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করাবে বলে নিয়ে গেলো ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে। পরিচয় হলো ঠিকই কিন্তু তখনও জানতে পারলাম না আমার কাজ সম্পর্কে।
একদিন বিকেলে বসে আছি হঠাৎ অরুণ ফোন করে বললো বাড়িতে জানিয়ে দিতে কাজের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হবে। আমি ওর কথামতো বাড়িতে জানিয়ে মা বাবাকে রাজি করলাম। অরুণের কথামতো তার সাথে গেলাম সেই পরিচয় হওয়া ভদ্রলোকের বাড়িতে। কিছু সময় বসার পর নিজের কাজ সম্পর্কে জানতে পারলাম। নিজের শরীর দিয়ে পরপুরুষদের ভুলাতে হবে। সেই মুহূর্তে খারাপ লাগলেও, চোখের কোণ জলে ভিজলেও মেনে নিলাম সবটাই। ভাবলাম, স্বামী, সংসার আজ থেকেও নেই, হয়তো আমাকে ভগবান তৈরি করেছেন পরপুরুষদের জন্যই। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। লজ্জা পেতাম অপরিচিত পরপুরুষের সামনে গায়ের থেকে একটা একটা করে পোশাক খুলতে, তাদের সাথে এক বিছানায় সময় কাটাতে। এখন আর এসব কিছুই মনে হয় না। পরপুরুষের ছোঁয়াটাই এখন আমার নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার সর্ব অঙ্গে এখন পরপুরুষের গন্ধ আর ছোঁয়া। যে শরীর এক সময় সিগারেটের ছ্যাঁকা খেতে অভ্যস্ত ছিলো সেই শরীর এখন দশজনের নানান স্বাদের স্পর্শে অভ্যস্ত। যে ঠোঁট কখনো স্বামীর আদরে ভিজতে পারেনি সেই ঠোঁট এখন রোজ ভিজতে থাকে পরপুরুষের উন্মত্ত আদরে। যে শরীর একজনকেই দেবো ভেবেছিলাম সেই শরীর এখন দশজনকে বিলোই। নেশায় যদি নিজেকে ডুবিয়ে না রাখি তাহলে শরীর বিলোবো কি করে?? তাই এখন মদ, সিগারেট কিছুই বাদ নেই আমার জীবনে। তোর সেই বারো বছর আগের গেঁয়ো মোনালিসা এখন বর্তমানে কলগার্ল মোনা নামে পরিচিত।
কথাগুলো বলতে বলতে মোনালিসার দুটো চোখ জলে ভরে উঠেছিলো। আমিও কথাগুলো শোনার পর নিজের চোখের জলকে আটকাতে পারিনি। আমাকে একটা কার্ড দিয়ে বললো, যদি এসব শোনার পরেও আমাকে বন্ধু মনে করিস, যদি ভাবিস গেঁয়ো মোনালিসার সাথে তুই যোগাযোগ রাখবি তাহলে রাখতে পারিস। মনটা আমার এতটুকুও বদলায়নি, বদলে গেছে পরিচয়টা।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।