গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সাত্তারুজ্জামান পিটু

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সাত্তারুজ্জামান পিটু, এফ.এফ. ভারতীয় তালিকা ঃ ৪৮২৭৭, গেজেট নম্বর কালিয়া-৪৭৫, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০৪০১০৪০০২৪, এমআইএস নম্বর-০১৬৫০০০২৭২২, মোবাইল নম্বর-০১৭১১৮১৫৪৬৮, পিতা ঃ শেখ মোছলেমউদ্দিন, মাতা ঃ শুকরননেছা, স্থায়ী ঠিকানা ঃ গ্রাম ও ডাকঘর ঃ কলাবাড়িয়া, উপজেলা ঃ কালিয়া, জেলা ঃ নড়াইল। বর্তমান ঠিকানা ঃ স্মরণীকা, পূর্ব সবুজ সংঘ রোড, পাবলা (দক্ষিণ), দৌলতপুর, খুলনা।
৪ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে শেখ সাত্তারুজ্জামান ছিলেন বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। ১৯৭১ সালে তিনি খুলনা বিএল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিংশ শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ ভাগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাগরনের এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়। তার জেরে ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণআন্দোলন শুরু হলে সাত্তারুজ্জামান পিটু সেই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেই আন্দোলনের জোয়ারে আইয়ুব খান পদত্যাগ করার পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। কিন্তু সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সময় ক্ষেপনের নীতি গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের চাপে অবশেষে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টুর পরামর্শে মাত্র কয়দিন পরেই আবার তা স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের এই হটকারী সিদ্ধান্তে সারা বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিরুেদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। দেশের এহেন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় তার নীতি নির্ধারণী ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম বলার সাথে সাথে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে শেখ সাত্তারুজ্জামানসহ এলাকার যুবক ছেলেরা স্থানীয় কলাবাগান হাই স্কুল মাঠে একজন সাবেক সেনাবাহিনীর সদস্যের অধীন সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। সেদিন মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি গ্রেফতার হলেও তার ঘোষণা অনুযায়ী সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র ছাড়া শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা আসছিল না। তাইতো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য মে মাসের শেষ সপ্তাহে সাত্তারুজ্জামান ভারতের পথে যাত্রা করেন। তারপর তিনি বাংলাদেশের বর্ডার পার হয়ে ভারতের বনগাঁ টালিখোলা ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে মাত্র ১০ দিন অবস্থান করার পর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করে তাদেরকে ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। প্রশিক্ষণ কালীন সময়ে সেখানে তারা নানা সমস্যার সন্মুখীন হতো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম নির্যাতনের স্মৃতি, আত্মীয় স্বজনহীন ভিন দেশে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের ধকল, যুদ্ধের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, খাদ্যাভাসের সমস্যা প্রভৃতি। কিন্তু শত্রুসেনাদের সমুচিত জবাব দান এবং বাংলা মায়ের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে ২ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে সাত্তারুজ্জামানদের ৮ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার কল্যাণি হয়ে বয়রা সাব-সেক্টরে প্রেরণ করা হয়। বয়রা ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সাত্তারুজামানদের একদিন বাংলাদেশের ভেতরে চৌগাছায় প্রেরণ করা হয়। সেখানে তারা এক বাড়িতে অবস্থান নেওয়ার পর রাজাকাররা সেই বাড়ির উপর আক্রমণ চালালে তারা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
শত্রুসেনারা চলে যাওয়ার পর তারা যখন বয়রা ক্যাম্পে ফিরে আসছিলেন তখন পথে তাদের তৎকালীন যেেশোর জেলার নড়াইল ও কালিয়া থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ও লোহাগড়া থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শরীফ খসরুজ্জামানের সাথে দেখা হয়। তারা তখন তাদের বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাত্তারুজ্জামান তখন তাদের গ্রুপের সাথে বয়রা ফিরে না গিয়ে মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডারগণের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাত্রা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বাহিনী মাগুড়া থানার পুলুম নামক স্থানে এসে নকশালদের মুখোমুখি পতিত হন। নকশালরা ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধার সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে তাদের ছেড়ে দেন। সাত্তারুজ্জামান তখন খালি হাতে নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে ২ জন লোককে সাথে নিয়ে আবার বয়রা সাব-সেক্টরে ফিরে গিয়ে গণপরিষদ সদস্য একলাসউদ্দিনের সাথে দেখা করে সব ঘটনা খুলে বলেন। এখলাসউদ্দিন তখন সাত্তারুজ্জামানকে কোন অস্ত্র প্রদান না করে তাকে কালিয়া থানার ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত করে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে বাংলাদেশের ভেতরে প্রেরণ করে থানা কমান্ডার ওমর ফারুকের কাছে রিপোর্ট করতে নির্দেশ প্রদান করেন।
কালিয়া থানা মুক্ত করার যুদ্ধ ঃ কালিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওমর ফারুকের নেতৃত্বে ৯ ডিসেম্বর থানার সকল মুক্তিযোদ্ধারা মিলিত ভাবে কালিয়া থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্পের উপর আক্রমণ শুরু করেন। ৩ দিন অবিরাম যুদ্ধ চলার পর ১২ ডিসেম্বর ৩৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ১৫০ জন রাজাকার আত্মসসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি সেনা ও ২ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও সাত্তারুজ্জামানসহ ৩ জন আহত হয়। তার মাত্র কয় দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সাত্তারুজ্জামানদের মত বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে গর্ব করতে পারি। তাইতো স্বাধীন দেশে তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা উচিৎ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।