T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় জয়ন্ত বিশ্বাস

অভিমানের অন্ত্যেষ্টি

 

লাক্ষ্ণৌ চিকনের ভারী নকশা করা সাদা শাড়ি আর খোলা চুলে রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে হিন্দোলা। চুলে গোজা হলুদ জারবেলাটা বা’দিকের কানের পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। আড়াই হাজার মাইলের পরিধি সম্পন্ন পৃথিবীতে অচেনা মুখের ভিড়ে যখন অকস্মাৎ একটা পরিচিত মুখের সাথে দেখা হয়ে যায় তখন এই গ্রহটাকে নিতান্তই ছোটো মনে হয়। যে মুখটা প্রায় সব সময় চেতন, অবচেতনের প্রান্তরে ছোঁয়া-ছুয়ি খেলে, রাতের প্রশান্তিকে উত্তাল করে, সেই মুখটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে চোখের সামনে এলে স্বভাবতই মহুয়ার নেশায় মাতোয়ারা হয় মন।

রেস্টুরেন্টে ঢুকেই নাক বরাবর দেওয়ালে একটা পেইন্টিং টাঙানো। কালো ক্যানভাসের উপর সাদা রঙের একথোকা বেনামী ফুলের একটা পেইন্টিং। এই ছবিটার ঠিক নীচের সোফাটাতেই বসে আছে নিসর্গ। টেবিলের উপর বর্ণহীন চিত্তরঞ্জক পানীয়ের গ্লাস। মদ বললেই চোখের সামনে মাতলামি, লোকজনের ভ্রু কুঁচকে চাওনি, ছোটোখাটো বচসা বা হাতাহাতির ছবি ভেসে ওঠে। তাই ‘মদ’ শব্দটায় নিসর্গর বড় আপত্তি। ওর কাছে চিন্তা ভাবনাকে রঙিন করার একটা উপাদান হল এই তরলটি। তাই চিত্তরঞ্জক পানীয়। এটা নিয়ে ছ’নম্বর। এই রেস্টুরেন্ট, এই বসার জায়গাটা নিসর্গ’র কাছে স্মৃতিতে সাজানো একটা শহরের মতো। এখান থেকেই জীবনের একটা অধ্যায় শুরু হয়েছিল। আগে ভটকা ছুঁতোও না। এখন আবার এটা ছাড়া অন্য কিছু ছোঁয় না।

প্রায় দু’বছর পর দেখা হল হিন্দোলার সাথে। কিন্তু দেখা হল কই! হিন্দোলা তে দেখেই নি নিসর্গকে। সঙ্গের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে নিসর্গর প্রায় পাশ দিয়েই এই সারির একদম শেষ টেবিলটায় গিয়ে বসেছে। ঢোকার সময়েই নিসর্গ দেখেছে ওদের। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই চেনা চন্দনের আতরের গন্ধ আর উর্ধ্বস্থিরাঙ্ক ছুঁয়ে যাওয়া উত্তেজনায় নিসর্গর কান যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হৃদস্পন্দন বেড়েছে। পৃথিবীটা যেন তার বেগ হারিয়েছে।

ওর তো এখানে আসার কথা নয়। একবারই এসেছিল, তাও নিসর্গর কথায়। দেখা হলই যখন তাহলে একবার কি গিয়ে কথা বলা উচিৎ?
“নাহ্ থাক”। সকলের সামনে হিন্দোলা যদি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কিংবা বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ বন্ধু যদি কেউ থাকে… এসব ভেবে নিসর্গর ভেতর থেকে একটা বড় ‘না’ সব দ্বন্দ্বের শেষে দাঁড়ি টেনে দেয়। ভাবতে ভাবতে শেষ পেগটায় চুমুক দিতে দিতে বিল মিটিয়ে দেয় নিসর্গ।

নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ভরা এই রেস্টুরেন্ট কেবল স্মৃতির সন্ধানই দিয়ে এসেছে, কিন্তু নিখোঁজ মানুষের সন্ধান দিতে পারেনি এতদিন। এইখানে বসেই একদিন শহরের আরেকপ্রান্তে থাকা মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিল, “ফুল চাইনা; ফুল তো তোমার সাক্ষ্য। স্বর্নচাঁপার পাপড়ির মতো তোমার ওই কড়ে আঙুলটা ধরে একটা বিকেল গায়ে মাখতে চাই”। এই সিটে বসেই একদিন দু’জনের মাঝের সীমানা ঘুচে সব এক হয়ে গিয়েছিল।

বুকের ভেতের হরপা বাণের সজোর ধাক্কা গুলো সামলে, মনটাকে টেনে সঙ্গে করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় নিসর্গ। টলমলে পায়ে দাঁড়াতেই পৃথিবীটা কম্পমান বোধ হয়। বেসামাল ভাবে দরজাটা খুলতে গিয়ে হাতলটা সশব্দে দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ায় প্রায় সকলের নজরই এসে পড়ে নিসর্গর উপর।
‘সর্গ’! বিস্ময়ে হিন্দোলার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় কালনদী জলে ভেসে যাওয়া নামটা। “কেমন আছ?আর শরীরের এ কি অবস্থা করেছ”? কালাতিপাত না করেই সিট ছেড়ে উঠে এসে হিন্দোলা প্রশ্ন করে । নিসর্গর বুকের ওঠা-নামাটা এতক্ষণে বেড়েছে কয়েক শ’গুণ। একগাল হেসে উত্তর দেয়,”ভালো আছি। একটু গোলাপী হয়েছি। তা তুমি এখানে”?

-কেন আসতে পারি না?

-না, তা একেবারেই না। আসলে তোমার জন্যে জায়গাটা উদ্ভট কিনা তাই।

যথোপযুক্ত প্রত্যুত্তর না দিয়ে হিন্দোলা বলে, “একটু বেশিই গোলাপী হয়েছ আজ। শরীরের এ’অবস্থা কী করে হল?শুকিয়ে গিয়েছো। গাল, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে তো। শরীর খারাপ নাকি”?
আগের মতোই স্মিত হেসে নিসর্গ বলে,”রোগা হতে বলতে তাই চেষ্টা করেছি”।

– চোখেমুখে তোমার দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। কেমন হলদেটে হয়ে গিয়েছো।

-নিজের যত্ন নিই। তাই glamourটা একটু খুলেছে। হাসতে হাসতে উত্তর দেয় নিসর্গ।

-বেশ। এতদিন পরে যখন দেখা আর কিছুক্ষণ বসে যাও।

– বসে কি হবে?

– এত্তদিন পড়ে… কোনও কথা থাকতে পারেনা আমাদের?

– তোমার যদি কথা থাকতই তাহলে এতদিনে একবারও কি সময় সুযোগ হয়নি তোমার? তুমি আনন্দ কর। আমি আসি।

চলে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা বাড়ালে হিন্দোলা নিসর্গর ডান হাতটা ধরে বলে, “মনে হচ্ছে you’re avoiding me like the plague…স্মোকিংজোনে গিয়ে দশটা মিনিট কথা বলি”?

-কি বলব? আমি তো বরাবরই তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারিনা।

-সময়ের সাথে হয়ত এই স্বভাবটাও বদলেছে তোমার। এখানে এভাবে দরজায় না দাঁড়িয়ে চল ওদিকটায় যাই।

-তুমি কিছু বলবে আমি তার ভুল ইন্টারপ্রিটেশান করবো, নিজের মনে প্রত্যাশা বাড়বে তারচেয়ে বরং চলে যাওয়াটাই ভালো।

-প্রত্যাশা যদি বাড়ে তো বাড়ুক। অসুবিধেটা কোথায়?

-তুমি কাজের মানুষ। কাজের মধ্যে ডুবে থাক। তাই তোমার অসুবিধে হয় না। কিন্তু আমার তো অখন্ড অবসর। প্রত্যাশারা আমার সাথে জল্লাদের মতো আচরণ করে। আমার অসুবিধা হয়।

অভিযোগের সুরে নিসর্গ প্রত্যুত্তর করে।

-তোমার এত জেদ! সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলবে তবু ওখানে বসবে না?

-যদি তোমার মনে হয় জেদ তাহলে তাই। তবে তোমার হয়তো মনে নেই তুমি বিরতি চেয়েছিলে। এতগুলো দিন পরে সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে তোমার বিরতির দরকার ছিল। আমার উপস্থিতি তোমার বিরতিতে বিঘ্ন ঘটাক আমি চাই না।

নিসর্গর কথার মাঝেই হিন্দোলা ওকে ধরে নিয়ে উল্টোদিকের ফাঁকা ঘরটায় নিয়ে বাসায়। আরেকটা চেয়ার টেনে নিসর্গর ঠিক সামনে বসে হিন্দোলা বলে,
” ধরে নাও আমার বিরতি পর্ব শেষ। এবার সব আগের মতো হবে। আমরা আবার একসাথে রাতের আকাশ দেখবো, সেপ্টেম্বর অক্টোবরের রাতে এয়ারপোর্টের রাস্তা দিয়ে হাত ধরে হাঁটবো, ছাতিমের গন্ধ গায়ে মাখবো।”

নিসর্গ বলে, “শিমুল তুলোর মতো ফুরফুরে বন্ধনটা যখন তোমার কাছে ক্লান্তির ঘামে ভিজে ভিজে আবার ভারী হয়ে যাবে তখন তোমার আবার বিরতির দরকার পড়বে। আর…. তখন আর নিজেকে সামলাতে পারব না”।

– তুমি তাহলে আমাকেই কাঠগোঁড়ায় তুলছ? তোমার কোনও দোষ ছিল না?

– না না। আমার দোষ তো পাহাড় প্রমান। প্রত্যাশার লালন করাটাই দোষ। আসলে expectations চলেই আসে। যাক সে সব। তুমি আমায় মূহুর্তে বাঁচাতে শিখিয়েছিলে, যাপনে ভরসা করতে শিখিয়েছিলে। আমি ওই সব মুহূর্ত, যাপন, ব্যাঞ্জনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিব্য কাটিয়ে দিচ্ছি। আগামীও কাটিয়ে দেব। তোমার পছন্দ গুলোকে অভ্যাস করে ফেলেছি। এসবের মধ্যেই তোমাকে পাই।

নিসর্গর বা’হাতের অনামিকার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল হিন্দোলা। আগে ছবিটা এরকম ছিল না। হিন্দোলা বলতো আর নিসর্গ মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আজ হিন্দোলা শুনছে। যেন সব জমা কথা আজই সেরে ফেলবে নিসর্গ। কথা তখনও বোধহয় শেষ হয়নি ওর। তবু ওকে থামিয়ে হিন্দোলা বলে,

-যদি তুমি স্মৃতি নিয়েই থাকতে চাও তাহলে ওই আংটি টা আজও পড়ে আছ কেন? খুলে ফেলোনি কেন?

– একটা আংটি যদি সম্পর্কের অস্তিত্বের প্রতীক হত তাহলে অনেক আগেই খুলে ফেলা উচিত ছিল আমার। কিন্তু এটাও একটা স্মৃতি। বুনতে শুরু হওয়া একটা স্বপ্নের স্মৃতি। “আংটিটার একটা পাথর তুমি আরেকটা আমি। আর মাঝেরটা আমাদের ভালোবাসার স্বরূপ”… এই কথাগুলোর সাক্ষী এই আংটিটা। তাই ওই কথা আর ওই স্বপ্নকে নিজের সাথে বয়ে নিয়ে চলছি। তুমি নেই ঠিকই কিন্তু যে শব্দ, বাক্য, যাপন গুলো তুমি আমায় দিয়েছিলে সেগুলো রয়েছে আর ওর মধ্যেই তুমি আছো। জানো তো হিন্দোলা, মানুষ থাকে না, সময় থাকে না কিন্তু মূহুর্ত গুলো রয়ে যায় প্রশান্তির ছায়া হয়ে।

আগে হিন্দোলাল সামনে দাঁড়িয়ে নিসর্গ কখনই নিজের অভিব্যক্তির প্রকাশ করতে পারত না। কিন্তু আজ না প্রকাশ করলে আর সময় পাওয়া যাবে না। স্মোকিংজোনটায় আজ লোকজনের ভিড় নেই। কাছের কোন ছাতিম ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসা ভেজা ছাতিমফুলের গন্ধে সম্পৃক্ত পুরো ঘরটা। সাময়িক নিস্তবদ্ধতা কাটিয়ে ধীর আর নীচু স্বরে নিসর্গ আবার বলতে শুরু করে , “আমি তোমার চোখে মিশেছিলাম আনন্দীকল্যান। প্রান অবধি পৌঁছতে পারিনি। দুটোর মধ্যে সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর একটা ব্যাবধান আছে।

দাম্পত্যের দায়বদ্ধতায় অবিশ্বাসী হিন্দোলার কাছে হয়তো কোন উত্তর ছিল না। তাই চুপ করে নিসর্গর কথা শুনছিল। নিসর্গ নিবিষ্টচিত্তে বলে চলে,

– বুঝলে হিন্দোলা মিশে যাওয়াটা ভীষণ প্রয়োজন। কেউ চোখে মিশে যায় আর কেউবা মনে। চোখে মিশলে সে চেতনায় ধরা দেবে, অদর্শন হবে Painful। আর চোখ পেড়িয়ে মনে যদি কেউ একবার মিশে যায় তাহলেই সাড়ে সব্বনাশ। চেতন, অবচেতন, সমর্পণ তখন সবতেই কেবল সে-ই মিশে থাকবে। অদর্শন আর দর্শনের অপেক্ষা দুই-ই তখন Painful না বরং Cheerful pain হয়ে উঠবে।

এই অবধি বলে আর কোন শব্দ, বাক্য ব্যবহার করে নি নিসর্গ। ও’টুকু সময় জানলার বাইরের আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ছিল হিন্দোলার ‘আবেশ’। তারপর খুব শান্ত শীতল ভাবে চোখ দুটো হিন্দোলার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল, তাই তো তোমায় কখন Painful হয়ে যেতে দিই নি আনন্দীকল্যান। এই শহরের একপ্রান্তে তুমি আরেক প্রান্তে আমি। এই দুরত্বটুকুর চারপাশে চারটে দেওয়াল ভাবতে পারলে সেই দেওয়ালের ওপর ছাদ হল ওই বিশাল আকাশ। সকাল – সন্ধ্যে যে বাতাস তোমায় ছুঁয়ে যায় সে বাতাস বয়ে এসে আমাকেও ছুঁয়ে যায়। তাই আজও আমি বিশ্বাস করি যে আমরা এক ছাদের নীচে থাকি, একে অপরকে স্পর্শ করি। মাদুর, বালিশ, কাঁথা ছেঁড়া হোক বা রেশমী মখমলের; স্বপ্ন দেখা তাতে থামে না। চোখ বুজলে যা গল্প কথা তাই লালিত স্বপ্ন। আর এখানেই আমার মতো অবাস্তববাদী মানুষগুলো জিতে যায় কারন ওই স্বপ্নটা বাস্তবের রুক্ষতার মতো নয়, কারন ওখানে কোন ফিলোজফির বাউন্ডারি থাকে না।
কথাটা শেষ করেই নিসর্গ উঠে দাঁড়িয়ে বেসামাল পায়ে স্মোকিংজোনের দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়।

প্রিয় ছাতিমের গন্ধে ভরা ঘরটায় একলা রয়ে যায় হিন্দোলা। রেলিং ধরে ধরে একটা একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে একসময় রেস্টুরেন্টের বিশাল কাঁচের দরজাটা খুলে শহরের ব্যস্ত ভিড়ে মিলিয়ে যায় নিসর্গ। যেতে যেতে হিন্দোলাকে দিয়ে যায় এক গভীর স্পর্শ; শব্দ-বাক্যের স্পর্শ, মনের কোথাও একটা দুলিয়ে বৃষ্টি দিয়ে যায় কাজল চোখের তারায়।
অলক্ষ্যে বসে থাকা মানুষটার পরিহাসের জেরে জীবন মরনের সন্ধিক্ষনে আজ এতগুলো বছর পর দেখা হয়েছিল নিসর্গ-হিন্দোলার।
হিন্দোলার বিরতিপর্বে নিসর্গর জীবন হয়ে উঠেছিল এক কঠিন সাজার সমার্থক। রাতগুলো কেটেছে নির্ঘুম আর সাথে বিশৃঙ্খল, অনিয়মিত জীবনযাপন। কয়েকমাস আগেই যখন বাড়াবাড়ি রকম শরীর খারাপ দেখা দিল তখন ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল লিভার ক্যান্সার। সাথের দোষর হেপাটাইটিস। যখন জানা গেল তখন জীবন সায়াহ্নে। নিয়ত শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার পেষনে জীজিবিষা হারিয়ে ফেলেছে নিসর্গ। কঠোর নিষেধ সত্বেও আজ সবার নজর এড়িয়ে একা বেড়িয়ে পড়েছিল শেষ ক্ষনটুকু রঙিন করে নিতে। আর সেখানে গিয়ে অদৃষ্টের পরিহাসটুকু জীবনের থেকে উপরি পাওনা হল নিসর্গর।

বাড়ি ফিরতেই শুরু হয় রক্তবমি আর হ্যালুসিনেশান। সকলেই বুঝতে পারে বিদায়বেলা আসন্ন। হিন্দোলা বাড়ি ফিরে হৃদয়ের আকুলতাকে প্রশান্ত করতে পারেনি কোনভাবেই। নিসর্গর বলা কথাগুলো, ওর অব্যক্ত ডাক যেন তীব্র সম্মোহন করছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করে ৯৮৫১৫০৯***। এতবছর পরেও নম্বরটা মনে করতে এতটুকু অসুবিধা হল না হিন্দোলার। কলার টিউনটা একই আছে, আমজাদ আলি খানের ভৈরবী। কিন্তু ফোনটা বেজেই গেল। তাহলে সামনা সামনি হয়েই সব অভিমান মুছে দেবে এই অঙ্গীকারে সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইল হিন্দোলা। সকালে চেনা পথ পেরিয়ে যখন হিন্দোলা পৌঁছল নিসর্গর বাড়িতে তখন বাড়িতে শুধুমাত্র কয়েকজন ভদ্রমহিলা আর ওনাদের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন নিসর্গর মা। চুলগুলো এলোমেলো। মাথায় বোধহয় বেশ করে তেলজল দেওয়া হয়েছে।

– “কী হয়েছে কাকীমার। বাবান কোথায়”?

-“বাবানের তো ঠিকানা বদলেছে। দেখা করতে চাইলে এখুনি চলে যাও রতনবাবুর ঘাটে”।

রতনবাবুর ঘাট তো শ্মশান। রহস্যের মতো মনে হল ভদ্রমহিলার কথাগুলো। অকস্মাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল গতরাতের নিসর্গর জীর্ণ মুখটা। আতঙ্কের তীব্র বজ্রঘাতে তক্ষুনি উন্মত্তের মতো বেড়িয়ে এসে রতনবাবুর ঘাটে যাওয়ার টোটো ধরে হিন্দোলা। মানুষ থাকে না, সময় থাকে না,থেকে যায় মুহূর্ত -নিসর্গর কথা গুলো কানে বাজছে।

মেঝের উপর একটা কাঁচা বাঁশের চালিতে দুধসাদা একটা কাপড় গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে হিন্দোলার আবেশ। নরম বালিশ ছাড়া যার ঘুম হতো না আজ তার মাথার নীচে মাঝখান দিয়ে চেরা শক্ত বাঁশ। কাল রাতের সেই শান্ত হাসিটা তখনও অম্লান। শুধু যে চোখদুটো মুগ্ধ হয়ে দেখত আনন্দীকল্যানকে সেই চোখদুটো তুলসী পাতায় ঢাকা। যেতে যেতে চোখ মেলে একবার চেয়ে দেখল না, আর দেখবেও না কোনদিন। এক আকাশ অভিমান, অনুযোগ নিয়ে একটু পরেই পঞ্চভূতে বিলীন হবে সে; যে কিনা হিন্দোলাকে প্রতি পল অনুপলে আবেশ উপহার দিত, হিন্দোলা তাই যাকে আবেশ বলে ডাকত। মানুষটা থাকবে না, তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি থাকবেনা, থাকবে শুধু মুহূর্তরা, অমীমাংসিত অভিমানেরা। চেনা পথ-ঘাট, গোধূলি রাঙা প্রিয় গঙ্গার ঘাট, আকাশ দেখার ছাদের চেয়ার, চন্দনের আতর, জুঁই, ছাতিমের গন্ধ, চিঠিপত্র, ডাকবাক্স, আনন্দীকল্যান সবাই থাকবে। । আর সবকিছু জুড়ে থাকবে আবেশের শূন্যতা। চাঁদের আলো মেখে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টাটুকু থাকবে সবার। নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে যেত যে মায়াবী কাজল চোখে সে’চোখে থাকবে জল। জোছনার মধ্যে দিয়ে নিসর্গ যখন ছোঁবে হিন্দোলাকে তখন হিন্দোলা বলবে,”ঢেউয়ের মতো ভেসে গেলে, বলে গেলে না আর কিছু বলার সময়ও দিলে না। ভালোবাসা আর চুমুর দিব্যি, তুমি আমার মনে মিশে আছো। শুধু মান-অভিমান, ভুল-ত্রুটি মার্জনা কর” ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *