অশনি-সংকেত মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত পৃথিবী? কি বলছেন বিজ্ঞানীরা।
একে রামে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর। করোনাতঙ্কে মানুষের এখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, তার সঙ্গে জুড়েছে গ্রহাণু নিয়ে আতঙ্ক! তার সঙ্গে এ দেশে পরপর ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, পঙ্গপালের হামলা — বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না। জুন মাসের ৮ এবং ২৪শে পৃথিবী লক্ষ্য করে বিশালাকৃতি গ্রহাণুরা ধেয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। একদম পরিস্কার ভাষায় বিজ্ঞানীরা বলছেন ৫ই জুন ভোর ৪ টা ৪৪ মিনিটে পৃথিবীর একদম গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে এক্সটেরয়েড ২০২০ কেএন ৫। এর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১২.৬৬ কিমি থাকবে বলে জানা গেছে। এই গ্রহাণুটি পৃথিবী থেকে ৬১ লক্ষ কিমি দূর দিয়ে দুরন্ত গতিতে বেরিয়ে যাবে জানিয়েছে সিএনইওএস। এই গ্রহাণুগুলির কোনও একটির সঙ্গে পৃথিবীর ধাক্কা লাগলেই মানব সভ্যতার বড়সড় ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নাসার ভাষায় বধ করার ফন্দি এঁটে সেদিন “অ্যাপোলো” গ্রহাণু (জ্যোতির্বিদদের ভাষায়) পাশ কেটে চলে গেলেও বাকি আছি আরও দুটি। আর সেই গ্রহানু পৃথিবীর কক্ষপথে আসবে এই মাসের ৮ এবং ২৪ তারিখ। সেই ‘ঘাতক’কে বধ করতে না পারলে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের ধ্বংস প্রায় অনিবার্য। নাসা জানিয়েছিল যে, বিশালাকার ৫ টি উল্কাপিন্ড পৃথিবীর একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। অসম্ভব দ্রুত গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে সেই ‘ঘাতক’। এক-একটা বিশাল চেহারার গ্রহাণু। আপাতত তার যা গতিপথ, তাতে পৃথিবীর ওপর তার আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই। অর্থাৎ ঘন্টায় ১১ হাজার ২০০ মাইল থেকে ২২ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে এই উল্কাপিন্ডগুলো। যদিও নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই উল্কাপিন্ড গুলোর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের সম্ভাবনা ১ শতাংশেরও কম। অবশ্য, এখনও এই উল্কাপিন্ড গুলোর কড়া নজর রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকর্ষের টানে যাতে পৃথিবীর দিকে চলে এলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রেখে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা।
ধ্বংস সম্পর্কে আলোচনা করার আগে আমরা জেনে নিই এই গ্রহাণু ব্যাপারটা কি? গ্রহাণু বা অ্যাস্টেরয়েড হল প্রধানত পাথর দ্বারা গঠিত বস্তু যা তারাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে। আমাদের সৌরজগতে গ্রহাণুগুলো ক্ষুদ্র গ্রহ (Minor planet অথবা Planetoid) নামক শ্রেণীর সবচেয়ে পরিচিত বস্তু। এরা ছোট আকারের গ্রহ যেমন বুধের চেয়েও ছোট। বেশিরভাগ গ্রহাণুই মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত গ্রহাণু বেল্টে থেকে নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করে। ধারণা করা হয় গ্রহাণুগুলো ভ্রূণগ্রহীয় চাকতির (Protoplanetary disc) অবশিষ্টাংশ। বলা হয় গ্রহাণু বেল্টের অঞ্চলে সৌরজগতের গঠনের প্রাথমিক সময় যেসকল ভ্রূণগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিলো তাদের অবশিষ্টাংশ বৃহস্পতির আবেশ দ্বারা সৃষ্ট মহাকর্ষীয় অক্ষ বিচলনের কারণে গ্রহের সাথে মিলিত হবার সুযোগ পায়নি। আর এই অবশিষ্টাংশই গ্রহাণু বেল্টের উৎপত্তির কারণ। কিছু গ্রহাণুর চাঁদও রয়েছে।
আর গ্রহাণু বেষ্টনী হল সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত, বেষ্টনী আকৃতি বিশিষ্ট সৌরজগতের অংশবিশেষ। অনিয়মিত আকার-আকৃতি বিশিষ্ট অসংখ্য গ্রহাণু ও গৌণ গ্রহ নামক সৌরজাগতিক বস্তু এ স্থান জুড়ে রয়েছে।পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু ও ট্রোজান গ্রহাণু থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য গ্রহাণু বেষ্টনী কে প্রধান গ্রহাণু বেষ্টনী বা প্রধান বেষ্টনী ও বলা হয়ে থাকে। বেষ্টনীর প্রায় অর্ধেক ভর এর সর্ববৃহৎ চারটি গ্রহাণু, যথা: সেরেস, ভেস্তা, প্যালাস ও হাইজিয়া – এর মাঝে নিহিত। গ্রহাণু বেষ্টনীর মোট ভর চাঁদের ভরের প্রায় ৪%, যা প্লুটোর চেয়ে যথেষ্টই কম, এবং প্লুটোর উপগ্রহ শ্যারনের (যার ব্যাস প্রায় ১২০০ কিমি) প্রায় দ্বিগুণ।
গ্রহাণু বেষ্টনীর একমাত্র বামন গ্রহ সেরেসের ব্যাস প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার (৫৯০ মা), অপরপক্ষে ভেস্তা, প্যাল্যাস ও হাইজিয়ার গড় ব্যাস ৬০০ কিলোমিটার (৩৭০ মা) এর কম। গ্রহাণু বেষ্টনীর বাকি সদস্যগুলো ক্রমশ আরও ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর, ধূলিকাসদৃশ আকার-আকৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। বেষ্টনীর বস্তুগুলো এতটা হালকাভাবে বিস্তৃত যে অসংখ্য মানবশূণ্য নভোযান কোন প্রকার দূর্ঘটনা ছাড়াই একে অতিক্রম করেছে। তবুও, বড় গ্রহাণুর মাঝে সংঘর্ষ মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে, যার ফলে গ্রহাণু পরিবারের সৃষ্টি হয়, যাদের কক্ষীয় বৈশিষ্ট্য ও গঠন উপাদান একই রকম। বেষ্টনীর একেকটি স্বতন্ত্র গ্রহাণুকে তাদের বর্ণালি অনুসারে শ্রেণিবিন্যস্ত করা হয় এবং অধিকাংশকেই: অঙ্গারময় (সি-শ্রেণী) সিলিকেট (এস-শ্রেণী) ও ধাতু সমৃদ্ধ (এম-শ্রেণী) – এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
নাসা জানিয়েছে যে, বিশালাকার ৫ টি উল্কাপিন্ড পৃথিবীর একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। ঘন্টায় ১১ হাজার ২০০ মাইল থেকে ২২ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে এই উল্কাপিন্ডগুলো। নাসার দেওয়া তথ্য অনুসারে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে পৃথিবীর একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছাবে এই উল্কাপিন্ডগুলো।
আর উল্কা (ইংরেজিতে meteoroid) হল কোন ধুমকেতুর অংশবিশেষ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ঘর্ষণে জ্বলে উঠলে তাকে উল্কা বলা হয়।এটি মহাকাশে পরিভ্রমণরত পাথর বা ধাতু দ্বারা গঠিত ছোট মহাজাগতিক বস্তু যা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে বায়ুর সংঘর্ষে জ্বলে উঠে। তখন একে উল্কাপাত (meteor) বলে। এই উল্কাপাতের জন্য দায়ী বস্তুগুলোকে উল্কা বলে। উল্কাপিণ্ড গ্রহাণুর তুলানায় আকারে অনেক ক্ষুদ্র। আকারে এরা ছোট ধূলিকনা থেকে ১ মিটার দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। এর চেয়ে ছোট বস্তুকে মহাজাগতিক ধূলিকনা বলে।
এসব উল্কার বেশীরভাগই গ্রহাণুর বা ধুমকেতুর অংশবিশেষ। বাকী অংশ মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষ। যখন কোন উল্কা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে তখন এর গতীবেগ প্রতি সেকেন্ডে ২০ কিমি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় (৭২,০০০ কিমি/ঘণ্টা; ৪৫,০০০ মাইল/ঘণ্টা।)। এসময়ে এ্যারোডাইনামিক্স তাপের কারণে উজ্জ্বল আলোক ছটার সৃষ্টি হয়। এই বাহ্যমূর্তীর কারণে উল্কাপাতকে “তারা-খসা” বা “নক্ষত্র-খসা” ( shooting star/falling star) বলে। কিছু কিছু উল্কা একই উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে প্রজ্জ্বলিত হয় যাকে উল্কা বৃষ্টি বলা হয়। প্রায় ১৫,০০০ টন পরিমাণ উল্কা, ক্ষুদ্র উল্কাকণা এবং মহাজাগতিক ধূলিকনা প্রতি বছর পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে।
নাসা আরও জানিয়েছে, আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের থেকেও বিশালাকার হবে একেকটি উল্কাপিন্ডের আয়তন। ১০৮ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১২০ ফুট পর্যন্ত চওড়া বলে জানিয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এই উল্কাপিণ্ডগুলির নাম রেখেছেন ২০২০ কেকে৭, ২০২০ কেডি৪, ২০২০ কেএফ, ২০২০ কেজে১ ও ২০২০ কেই৪।
পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এই উল্কাপিন্ড গুলো কতটা ক্ষতি করতে পারে পৃথিবীর? এ বিষয়ে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই উল্কাপিন্ড গুলোর পৃথিবীর সংঘর্ষের সম্ভাবনা ১ শতাংশেরও কম। অবশ্য, এখনও এই উল্কাপিন্ড গুলোর কড়া নজর রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকর্ষের টানে যাতে পৃথিবীর দিকে চলে এলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রেখে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এই উল্কা পৃথিবীতে ধাক্কা মারলে ভূমিকম্প, সুনামি সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে পৃথিবীকে। সতর্ক করেছে নাসা।
আগামী ৮ এবং ২৪ তারিখ যে দুটি গ্রহাণু আসতে চলেছে-
১। Asteriod 2013 XA22 – June 8 এই গ্রহাণুটির ব্যাসার্ধ ৫৭০ মিটার। পাঁচটি ফুটবল মাঠ বা দুবাইয়ের এনটিসার টাওয়ার ঢুকে যেতে পারে এর ভেতর। আগামী ৮ জুন দুপুর ২.৫৭ মিনিট নাগাদ তা ঘন্টায় ১১ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে। পৃথিবীর কাছ থেকে এর ন্যূনতম দূরত্ব থাকবে ১.৩ মিলিয়ন মাইল।
২। Asteriod 2010 NY65 – June 24 ১৭১ ফুট ব্যাসের আরও একটি গ্রহাণু ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজের তথ্য অনুসারে গ্রহাণুটি -আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজের তথ্য অনুসারে ২০২০ কেই৪ নামে চিহ্নিত গ্রহাণুটি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে ঘণ্টায় ২৪,০৫০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে এটি।
মহাকাশ গবেষক এলন মাস্ক ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসেই এই গ্রহাণুর কথা বলেছিলেন, যা পৃথিবীর উপর আঘাত হানতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন-. এখন দেখার আগামী ৮ আর ২৪ কি অপেক্ষা করছে পৃথিবীর জন্য।এত আশঙ্কার মধ্যে আশার কথা শুধু এই টুকুই।‘‘পৃথিবীর ঘাড়ে এসে পড়ার সম্ভাবনা কতটা রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য এখনও কিছু সন্দেহ রয়েছে।’’