হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ১১)

চললুম ইউরোপ

কি করে পলকের মত পেরিয়ে গেল স্বপ্নের রাত। সকাল হ’ল মেঘে, কুয়াশায়। অবাক চোখে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে আটকে গেলাম কাঁচের দেওয়ালের গায়ে। যেন একটা প‍্যানোরমা খুলে গেছে! শান্ত রহস‍্যময় লেকটা আস্তে… আস্তে ঘন কুয়াশার চাদর খুলে ফেলছে। বিশাল একটা দৃশ‍্যপট স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। প্রকৃতির ঘুম ভাঙছে আমার চোখের সামনে,অনির্বচনীয়! স্রোতের মত পর্যটক আসেন, যান ….বদলে যায় জীবন। শুধু স্বর্গীয় ঐশ্বর্যে অবিচল থাকেন প্রকৃতি, তাঁর অনন্ত সৌন্দর্য নিয়ে।
দেখার চোখ নিয়ে এসেছি তাই আটকে গেলে তো চলবে না ! নতুন রহস‍্য, নতুন সৌন্দর্যের কাছে তো পৌঁছতেই হবে। আমরা ব্রেকফাস্ট করে আবার পৌঁছে গেলাম মন্ত্র স্টেশনে। ট্রেনে করে প্রথমে গেলাম ভিস্প(Visp) স্টেশনে।এখান থেকে ট্রেন বদল করে আমাদের যেতে হবে জারম‍্যাট (Zermatt)। এবারের ট্রেনটা ছোট..,… অনেক চড়াই ভেঙে চলেছে। ৬০০ থেকে ১৬০০মিটার উচ্চতায় পৌঁছাব আমরা। তবে মসৃণ চলন ; আমরা টের পাচ্ছি না যে এ বেচারা এত কষ্ট করে হাজার মিটার মানে এক কিলোমিটার উচ্চতার রাস্তা পেরোচ্ছে । চারদিকের দৃশ‍্যপট সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমরা তুষাররাজ‍্যে ঢুকে পড়ছি। বলা যায় বরফ গ্রাস করে নিচ্ছে প্রকৃতি। আজ ২২ডিসেম্বার ২০১৯, এসময় আল্পসের গায়ে আরোহণ তো তুষারযুগে ফিরে যাওয়ারই সামিল । আমাদের গন্তব‍্য……
গর্নারগ্রাথ (Gornergrat)।
ইউরোপের সেকেন্ড হাইয়েস্ট রেলস্টেশন। প্রথমটাও অবশ‍্য এইদেশেই মানে সুইতজারল‍্যান্ডের জুংফ্রাউ( Jungfrau ) তবে GGB অর্থাৎ Gornergrath bahn রেলওয়ে একটা পার্বত‍্য রাক রেলওয়ে। ১৮৯৮ সালে শুরু হয়েছিল এই উত্তুঙ্গ রেলওয়ে ট্র‍্যাক। পর্যটনের এই আশ্চর্য ম‍্যাজিক সুইতজারল‍্যান্ডের অন‍্যতম মূল আকর্ষণ। পর্বতের দশহাজার ফুট উচ্চতাতেও এই মসৃণ রেলজার্ণি যেন স্বপ্নের মত। আরও একটা চমক হল এটা পৃথিবীর প্রথম বিদ‍্যুৎচালিত রেল ব‍্যবস্থা। যদিও এখন এটা চলে ইকো ফ্রেন্ডলি ব‍্যবস্থায়। অবশ‍্য আরও পালক আছে মুকুটে……
এই কগ রেলওয়ে হল পৃথিবীর সর্বোচ্চ উন্মুক্ত রেলওয়ে।মানে মাটিতে যেমন লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটে যায় তেমনই খোলামেলা। পাহাড়ের গায়ে পাইনবন যেন বরফের ভাস্কর্য ।অসংখ‍্য ঝর্ণা বরফের ফিতে হয়ে ঝুলছে। কি আশ্চর্য লাগছে এগুলো সব সত‍্যি দেখছি তো ! এই যাত্রার নাম কগ রেলওয়ে অর্থাৎ রেলট্র‍্যাকে একরকম লিভার লাগানো থাকে। যাতে চাকা পিছলে না যায়। খোঁচা খোঁচা কাঁটা ওয়ালা। সাইকেলের চেন যেমন কাঁটাওয়ালা লিভারের সঙ্গে আটকানো থাকে অনেকটা সেইরকম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর্যটন এদেশের অন‍্যতম মূল আয়ের উৎস। স্বীকার করতেই হয় যে এই শিল্পকে সুইস জাতি সম্পূর্ণ মনযোগ আর যত্ন দিয়ে লালন করছে। তাদের মূল উদ্দেশ‍্য হল যাত্রীস্বাচ্ছন্দ। তাই সারা পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসু মানুষ তাদের সমস্ত সঞ্চয় উপুড় করে দিতে দ্বিধা করে না এখানে এসে। অবশেষে ১৬০৪ মিটার বা ৫২৬২ ফুট উঁচু জারম‍্যাট স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অন‍্য ট্রেন ধরতে হবে। প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দেখলাম বরফের বৃষ্টি হচ্ছে। তবে নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই তাই দ্বিধা সরিয়ে এই প্রথম বরফের মধ‍্যে নেমে দাঁড়ালাম আর সঙ্গে সঙ্গে গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেল। বরফে পা ডুবিয়ে বরফবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওপরে ওঠার অন‍্য ট্রেন ধরতে গেলাম।
আমাদের এখানে রেললাইনের মাঝখানে নুড়ি মানে পাথরের টুকরো থাকে কিন্তু ওখানে পুরো বরফের চাদরের ভেতর থেকে রেললাইনের মাথাটুকু শুধু জেগে আছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।