চললুম ইউরোপ

রিটায়ার করলুম বলে লোটাকম্বল নিয়ে বিদেশ-বিভুঁয়ে বেরিয়ে পড়লুম, এ আমার স্বভাব নয়। বিশ পঞ্চাশ হাজার খরচ করে দেশে কত জায়গায় বেড়ানো যায়। দিব্বি দেশী খাবার খাও আর পটাপট ছবি তুলে এদিক ওদিক পাঠাও। কিন্তু ছেলে একেবারে শেকড় বাকড় ধরে টান দিল। ‘ মা বাবা তোমাদের চাকরির Bondage এখন নেই এবার আমার কাছে আসতেই হবে।আর গরমকালে ইউরোপে আসার মানে নেই এখানে ৩৫-৩৬ডিগ্রী ও হচ্ছে আজকাল।’ ও বাবা বলে কি ডিসেম্বর জানুয়ারিতে আমরা ইউরোপে যাব… আমাদের তো মাথায় হাত!অগত্যা মধুসূদন! ছেলের আবদার মানতেই হল। ১৪ই নভেম্বর আমরা রওয়ানা দিলুম আমস্টারডাম, শীতের আগে গা সইয়ে নিতে।
ছেলের প্রোগ্রাম ক্রিসমাসের লম্বা ছুটিতে ন’দিনের জন্যে আমাদের সুইটজারল্যান্ড বেড়াতে নিয়ে যাবে। নাও এবার পাহাড়প্রমাণ জামা জুতো কেনো তবুও যে কি হতে চলেছে কে জানে! বাবাইয়ের ইন্ডেন্টও তো পেল্লায়। নতুন পুরোনো সুটকেসে প্রাণপণে ঠাসা হতে লাগল। বাটার জুতোর পেটে ছোট ইলেকট্রিকাল গ্যাজেট বা ক্যাসারোলের ভেতরে বোরোলিন, নেলকাটার ইত্যাদি।এখন এই গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে তো যেতে হবে! বাবাই এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট করেছে এইজন্যে যে ওরা ৪৬ কিলো এ্যলাউ করছে পারহেড, তারওপর ক্যাবিন লাগেজও আছে। এরপর রইল ওষুধের ফিরিস্তি। সুগার প্রেশার কি নেই আমাদের… পুরো তিনমাসের প্যাকেজ ! ওদেশে তো আর পাড়ায় পাড়ায় ওষুধের দোকান নেই যে মাথা ব্যথা করছে বা পেটখারাপ ওমুক ওষুধটা দাওতো ভাই বলা যাবে।হোমিও বা এ্যলোপ্যাথি যাই নাও সব প্রেসক্রাইব করিয়ে নিতে হবে না নিলেই গন্ডগোল!

যাই হোক সাতসতেরো ঝামেলা পেরিয়ে দুগ্গা দুগ্গা করে রওনা দিলুম। ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে সকালের ফ্লাইটে প্রথমে দিল্লী…. দিল্লী থেকে ফ্রাঙ্কফার্ট… সেখান থেকে আমস্টারডাম।
ছেলে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে নিখুঁতভাবে। তবু যাত্রার দিনআষ্টেক আগে থেকে চলল ট্রেনিং।ইমিগ্রেশন কাউন্টারে কি করতে হবে… লাগেজ কিভাবে ট্রান্সফার মার্ক করিয়ে সোজা আমস্টারডামে রিসিভ করা যাবে ইত্যাদি। সবশেষে একটা চমৎকার ব্যবস্থা করেছে একজনের অন্তত Wheelchair. তাতে শুধু হাঁটার কষ্ট কমবে তাই নয়, Chairoperator আমাদের এয়ারপোর্টে মুস্কিল আসান হয়ে থাকবে। বিশেষত ফ্রাঙ্কফার্টে ভাষার সমস্যা তো থাকবেই। মর্নিং ফ্লাইটে দিল্লী তো পৌঁছে গেলুম সকাল সকাল,এবার দুপুর দুটোয় পরের ফ্লাইট। তা বেশ! লম্বা জার্নি এবার সাত সাড়ে সাত ঘন্টার। বসে বসে মন শাটল ককের মত একবার বাড়ির দিকে দৌড়য়… কিজানি কোন বিলিব্যবস্থা বাকি থেকে গেল,আবার ছেলের কাছে,এতদিন পর আমাদের দেখে ওর মুখটা কেমন হবে!অবশেষে চড়ে বসলাম বিশাল এয়ারক্র্যাফ্টে। চারদিকে চেয়ে দেখছি এত লোক!তিনটে রো আমাদের জায়গা ছিল মাঝের রোতে।বেশ কয়েকটা ফুটফুটে বাচ্ছা দেখে মনটা বেশ তরতাজা হয়ে গেল। কেউ বাবার কোলে হেঁটে বেড়াচ্ছেন কেউ মায়ের কোলে দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। চটপট ছেলেকে ফোন করলাম এর পরে তো আবার বন্ধ রাখতে হবে। তবে এবার দেখলাম টেকঅফ করার কিছু পরে বলে দিল মোবাইল,ল্যাপটপ এবার চালু করা যাবে। অনেকেই টপাটপ অন করে কেউ কাজ শুরু করল তো কেউ সিনেমা চালিয়ে দিল কানে হেডফোন গুঁজে। বড় বোয়িং বিমান তাই সামনের দিকে মাঝে আবার পেছনেও ওয়াশরুম আছে। আমার বেশ ইচ্ছা কাছাকাছি যে বাচ্ছাটা আছে তাকে একটু হাই হেলো করা একটু কোলে নেওয়া কিন্তু আমার কর্তা নারাজ। তিনি আবার এসব আদেখলেপনা পছন্দ করেন না। যাই হোক অবাক বিস্ময়ে আকাশের ভোলবদল দেখতে দেখতে চললাম। যত এগোচ্ছি মনে হচ্ছে বাবাইয়ের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি! এই ফ্লাইট প্রায় দেড়ঘন্টা লেট তাই সময় অনেক কমে গেল লাস্ট ফ্লাইট ধরবার। ছেলেকে আপডেট দিতে দিতে চললাম। আর আমার সহযাত্রী এমনিতে গম্ভীর হলে কি হবে ছেলের ফোন এলে মুখে বাল্ব জ্বলে যায়।
গন্তব্যে গিয়ে দেখি ওমা হুইলচেয়ার আসেনি… ব্যস আবার হ্যালো বাবাই ! আমার বিপদভঞ্জন রেডি।

আর একটা জার্নি পেরিয়ে যখন ফ্লাইট Schipol airport ছুঁলো আমার চোখে জল… প্রায় আড়াই বছর পর আবার আমরা একসঙ্গে! এটা নাকি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত আর উৎকৃষ্ট এয়ারপোর্ট কিন্তু আমার আর কিছু মনে পড়ছে না… লাগেজ লাইনে ছটফট করছি আর কতক্ষণ! মুহুর্মুহু ফোন আসছে… শান্ত গলায় বলে দিচ্ছে কি কি করতে হবে কোনদিকে যেতে হবে।
আমাদের রাত দুটোয় পৌঁছে গেট পেরোতে প্রায় তিনটে।ওর বাবার গলাও ধরা ‘ ঐ তো ঐ তো বাবান ‘
এসে দাঁড়ালাম নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে।
চলবে