• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ৫)

চললুম ইউরোপ

আজ দিনটা একটু অন‍্যরকম….রোদ উঠেছে। রোদ যে এত দামী তা এখানে এসে বুঝলুম , আমাদের দেশে তো অঢেল রোদ্দুর, রূপসী বৃষ্টি! সত‍্যি আমাদের প্রকৃতি আর ঋতুর এমন যুগলবন্দী আর কোন দেশে আছে? আজ আর ঘরে থাকা চলে না , তাই আমস্টারডামের ম‍্যাপ নিয়ে বসলাম…. কাছাকাছি একটা বিশাল পার্ক আছে। চটপট তৈরী হলাম কাজ সেরে । কত্তামশাই মন দিয়ে জামাকাপড় ইস্ত্রি করছেন।
পার্কে গিয়ে তথ‍্যভাঁড়ার খুলে বসলাম।
নেদারল‍্যান্ড নামের মানে
” লো লাইয়িং ল‍্যান্ড”
(Low lying land )
আগে এর নাম ছিল হল‍্যান্ড।
হল‍্যান্ড মানে ” উডেড ল‍্যান্ড” বা উডল‍্যান্ড।(Wooded land or Woodland ) ইউরোপের উত্তর পশ্চিম দিকে এর অবস্থান। নেদারল্যান্ডের উত্তর পশ্চিমে নর্থ সি, পূর্বদিকে জার্মানি,দক্ষিনে বেলজিয়াম সীমানা। পশ্চিম আর উত্তর নেদারল‍্যান্ডসের প্রায় ২০ভাগ অঞ্চল সমুদ্রতল থেকে নিচু। পুবে আর দক্ষিনে ছোট পাহাড় আর উঁচু জায়গা। মূল নদী রাইন (Rhine) মিউজ (Meuse) এমস(Eems)আর শেল্ডট (Schelde )।জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ, অফিসিয়াল ভাষা ডাচ।
বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডস এর সীমানা পৃথিবীতে সবচেয়ে কমপ্লিকেটেড ইনটারন‍্যাশনাল বাউন্ডারি।এই বর্ডার ৪৫০ কিমি দীর্ঘ।মূলত মিউস নদীভাগ করেছে দুটো দেশকে আর স্থলভাগে খুব আশ্চর্যভাবে ক্রশ চিহ্ন দিয়ে আলাদা করা আছে সীমানা। একই বাড়ির কিছু অংশ এই দেশে তো কিছু অংশ ঐ দেশে। যেমন খুব আশ্চর্যভাবে মিলে
আছে আমাদের বাগদা অঞ্চলে ভারত আর বাংলাদেশের সীমানা।
এখানে শুনেছি শোবার ঘর একদেশে পড়েছে তো রান্নাঘর অন‍্যদেশে। সেখানে
” বাড়ির কাছে আরশিনগর, এক পড়শি বসত করে”।
বাঙালিরা ভাষায় এক ভালবাসায় এক।
সমুদ্রতলের নিচের অংশগুলোকে বলে পোল্ডারস। আয়তন রাফলি ৪১৮০০ স্কোয়ার কিলোমিটার। ১৯৮৬ সালে নেদারল্যান্ডস নতুন বারোটা প্রদেশ অর্জন করেছে কিন্তু প্রতিবেশি বেলজিয়াম বা জার্মানির জমি অধিকার করে নয়।বরং নেদারল্যান্ডস বড় হয়েছে ডাইকস আর পোল্ডারসের সাহায্যে। তাই যখন বলা হয় ভগবান সৃষ্টি করেছেন পৃথিবী তখন এটা বলা যায় যে ডাচরা তৈরী করেছে নেদারল্যান্ডস। ৪৫১ কিলোমিটার সমুদ্রতীর নর্থ সি র পাশে। এর নেপথ‍্যে আছে বহু বছরের সমুদ্রবিজয়ের আগ্রহ আর ভয়ানক বন‍্যা থেকে বাঁচার চেষ্টা। প্রায় দুহাজার বছর ধরে ডাচরা সমুদ্রপ্রলয় থেকে দেশকে রক্ষা করেছে আর অনলস চেষ্টা করেছে জমি তৈরী করার। আর্থ মাউন্ডস এর ওপরে গ্রাম তৈরী করেছিল এদেশের লোক। টারপেন তৈরী করেছিল গ্রামগুলোকে সমুদ্রের গ্রাস থেকে বাঁচাবার। হাজার হাজার টারপেন আজও আছে নেদারল‍্যান্ডসে। ১৪ সেপ্টেম্বর ১২৮৭ সালে ভেঙ্গে পড়েছিল এই ডাইকস আর টারপেন ব‍্যবস্থা।
সারা দেশ বন‍্যায় ভেসে গিয়েছিল। সেন্ট লুসিয়া ফ্লাড। প্রায় ৫০০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল এই বন‍্যায়। তবে এর ফলে নতুন তীর তৈরী হয়েছিল।
(Zuiderzee)জুয়েদারজি হ’ল অগভীর উপসাগর যা তৈরী হয়েছিল উত্তর সমুদ্র থেকে। আর এখান থেকেই উঠে এসেছে সবচেয়ে বড় আর উর্বর চাষের জমি।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ডাচরা চেষ্টা করে গেছে কি করে জুয়েদারজি উপসাগর থেকে ধীরে ধীরে জল সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
অনেক দিনের অধ‍্যবসায় আর পরিশ্রম দিয়ে তারা ছোট ছোট জমি হাসিল করতে লাগল সমুদের গা থেকে। এগুলোর নাম ডাইকস আর পোল্ডারস।
হাজার হাজার পাম্প আর ক‍্যানাল কে কাজে লাগানো হ’ল এই মাটিকে জলমুক্ত করতে। এই কাজে তারা সমুদ্রের শক্তিশালী বাতাসকেও কাজে লাগাল।১২০০ সন থেকে চালু হ’ল উইন্ডমিল। আর এই উইন্ডমিলগুলো সর্বশক্তি দিয়ে উর্বর জমি থেকে বাড়তি জল সরানোর কাজ করতে লাগল। ক্রমে এই মিলগুলো হয়ে উঠল দেশের অন‍্যতম পরিচয় ।
কিন্তু আবার ঘনিয়ে এল দুর্বিপাক ! আবার সেই সমুদ্রদানব ধেয়ে এসে…. সব স্বপ্ন চুরমার করে দিল ডাচদের। ১৯৫৩ সালের ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি প্রচন্ড ঝড়ে সমুদ্রতল প্রায় ১৫ফুট উঁচু হয়ে বজ্রের মত নেমে এ’ল রাতের অন্ধকারে। ঘুমন্ত ডাইকস (অধিকৃত জমি ) থেকে সলিলসমাধি হ’ল প্রায় ১৮০০ মানুষের।
এ যেন নিজের জিনিস আবার ছিনিয়ে নিল সমুদ্র। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ৭২০০০লোককে সরাতে হল তীরবর্তী জায়গা থেকে দূরে…. অসংখ‍্য পশুপাখি, সম্পত্তি ভেসে গেল।

শুরু হ’ল মরণপণ লড়াই ! ধীরে ধীরে নিজেদের সব শক্তি সংহত করে ডাচরা নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করল।১৯৫৬ সালে আইন প্রণয়ণ করে আরম্ভ হল নর্থ সি প্রোটেকশন ওয়ার্ক। এই বিশাল আশ্চর্য কর্মকাণ্ড আধুনিক বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ‍্যে অন‍্যতম হয়ে উঠল আমেরিকার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দের হিসেবে। ডাচ ইঞ্জিনিয়ার রা তৈরী করল অনেক ড‍্যাম , শ্লুইস, লকগেট আর প্রোটেকটিভ ওয়াল যা সমুদ্রকে বলতে চাইল
“দ‍্যাটস ফার এন্ড নো ফারদার ” । নতুন প্রদেশ হ’ল ‘ ফ্লিভোল‍্যান্ড ‘,যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করত সমুদ্রের জল। আজ এদেশে ২৭% জমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে আর সেখানে দেশের ৬০ শতাংশ লোক বসবাস করে। দেশটার গড় উচ্চতা মাত্র ৩৬ ফুট। বিশাল অংশ আজও বন‍্যাপ্রবণ।
জানি না কালের হিসেব কি বলবে! তবে রবীন্দ্রনাথে বিশ্বাস রেখে বলি…..

          “নিদারুণ দুঃখরাতে
.                    মৃত‍্যুঘাতে
.          মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
.তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?”

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *