হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ২২)

চললুম ইউরোপ

একে একে পেরিয়ে গেল ৩০০সেকেন্ডের সময়সীমা। প্রতি ঘন্টায় পাঁচ মিনিটের লাইট শো। যদিও একসময় নাকি দশ মিনিট টাইম সলট ছিল। আলোর অপূর্ব কারিগরী ভোজবাজির মত অদৃশ‍্য হয়ে যেতেই শুরু হল শীর্ষশিখা। যাই হোক আকাশলীনার স্বপ্ন শেষ হতেই মন অস্থির হয়ে উঠল আমার মাটির প্রদীপ…….. আমার ছেলে আর ছেলের বাবার জন‍্যে। খানিকটা ওপরে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে। ক‍্যামেরা নিয়ে ব‍্যস্ত বাবাই ; আমি গিয়ে যোগ দিলাম আমার বৃত্তে। ‘ কি মা কেমন দেখলে?’ আমি হেসে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। চল এই জায়গাটা ঘুরে দেখি কেমন মেলার মত নানান জিনিস বিক্রী হচ্ছে। মেটালের ছোট বড় নানা সাইজের আইফেল টাওয়ার…. কোনটা কপার কালার কোনটা কালচে স্টীল রঙের ঝকঝকে সিলভার কালার ও আছে।

আসলে মানুষ যেমন ঝিনুক কুড়িয়ে সাগরের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যায় প্রিয়জনদের কাছে এও তেমনি। বেশিরভাগ বিক্রেতা আফ্রিকান ছোট দশ বার বছরের ছেলেও আছে আবার পূর্ণবয়স্ক মানুষও আছে। দরদাম করতে করতেই একটা হইচই শুরু হল আর সবাই যে যার পশরা গুটিয়ে চম্পট। শুনলাম পুলিশ আসছে।এতো আমাদের দেশের মতই পুলিশ মাঝেমাঝে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যায় হকারদের যেমন। তবে কি বিনা অনুমতিতে দোকান চলে? বুঝলাম এরা গরীব আফ্রিকান তাই কিছু হম্বিতম্বি তো মানতেই হবে ওদের। তবে খুচরোখাচরা অপরাধ যে ওরা করে না তা নয়। আর তাই ওরা দাগী। দারিদ্রসীমার নিচের দেশগুলোর সারা পৃথিবীতেই এক অবস্থা। ছেলে বলল মা তুমি আবার আটকে গেলে চটপট কর,যা হোক কিছু খেয়ে এবার ফিরতে হবে…… রাত হয়ে যাচ্ছে। তোর মায়ের আর কবে এসব হুঁশ থাকে! স্ট্রাইক চলছে গাড়িঘোড়া কি পাব কে জানে! তাড়াতাড়ি সওদা সেরে আবার সেই ক্রেপ খেলাম। বাবাই ফেরার জন‍্য গাড়ি বুক করেছে পঞ্চাশ ইউরোয়। সে ব‍্যাটার টাইম হয়ে গেছে তবু পাত্তা নেই। আমরা রাস্তায় নেমে হাপিত‍্যেশ দাঁড়িয়ে। ফোনও ধরছে না….. বাবাই বলল চল এ মনে হয় বেটার অফার পেয়ে গেছে, আসবে না। যতটা পারি আমরা পায়ে হেঁটে এগোই। অগত‍্যা রওয়ানা দিলাম। আমি তো গুড়গুড় করে শামুকের মত হাঁটছি, হাঁটু বেশ মালুম দিচ্ছে ব‍্যথার। ওরা একটু এগোয় আর থেমে যায় আমার জন‍্যে। দুটো স্টপেজ মত হেঁটে বাসস্টপের চেয়ারে বসে পড়লাম। বড় বড় শ্বাস পড়ছে দেখে ছেলের মায়া হল বলল মা একটু বিশ্রাম নাও আমি আবার গাড়ির চেষ্টা করছি। নাঃ কেউ ফোন ধরছে না।

আবার উঠে হাঁটতে লাগলাম এবার ছেলেকে ধরে। মনকে বললাম বাবামা কে নিয়ে ছেলেটা বিপদে পড়েছে তুমি কি চেষ্টা করবে না ওকে সাহস দিতে! আবার একটা স্টপেজ পেরোলাম….. বাবারে এদের স্টপেজগুলো কি লম্বা। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলে খুঁজে জল নিয়ে এল….. দোকানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । পরের স্টপেজটা পেরোনার সময় বীরদর্পে জিজ্ঞেস করলাম বাবা, এবার বোধহয় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেছি…. তাই না? ছেলে করুণ মুখে বলল তাহলে তো প্রায় হোটেলে পৌঁছে যেতাম মা। দুকিলোমিটারও হয়নি। লজ্জা পেলাম আমার চেয়ে দশ বছরের বেশি সিনিয়র মানুষটা দিব‍্যি হেঁটে যাচ্ছেন….. সত‍্যি আমি অপদার্থ। ছেলের কানে আবার মোবাইল একজন আসছে বলল একশ’ ইউরো নেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রিএ‍্যাক্ট করলাম কেন আমরা তো প্রায় অর্ধেক রাস্তা হেঁটে এসেছি। উঃ মা রাত হচ্ছে এখন মিটার বাড়বেই। যাই হোক অবশেষে তিনি এলেন….. গাড়িতে বসে বুঝলাম আরাম কাকে বলে! পাদুটো কাকে ধন‍্যবাদ দিল কে জানে। পাঁচ মিনিট পরেই বলল নেমে যান, সেকি হোটেল তো আসেনি।

কত্তা বলল আরে কাছেই তো চল হেঁটে যাব। আমি যতই আপত্তি করি বাপব‍্যাটার চাপে নামলাম। সত‍্যি রাস্তা পেরিয়ে আমাদের ফুটপাথ চিনতে পারলাম। আজ আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই….. তাই শুভরাত্রি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।