ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ৮)

রূপকথা পৃথিবীর

তোমাকে ভুলিনি প্রথম আঁকার খাতা
তোমাকে ভুলিনি ডায়েরির ছেঁড়া পাতা
তোমাকে ভুলিনি কলকে ফুলের মধু
তোমাকে ভুলিনি ছোট্টবেলার ছাতা !
এই অসম ফাইনাল খেলার বিবরণ দিয়ে নিজের মন আর ভারি করতে চাই না।সেকেন্ড হাফে বংশী, শ্যামল ,কানু তিনজনেই বাঘের বাচ্চার মতন খেলে গেল। কানুর ঠোঁট থেকে রক্ত গড়াচ্ছে , কোনরকমে বাঁ হাত দিয়ে তুলো চেপে লড়ে যাচ্ছে , আমি অনায়াসে ড্রিবল্ করে , গোলের সামনে পৌঁছে গিয়েও ; ওদের গোলকিপারের মার খেয়ে আবার গুটিয়ে গেলাম। বাবা কেমন নির্লিপ্তি সন্ন‍্যাসীর মতো আজ কোন কথা বলছে না। বুঝতে পেরেছে , তার আদরের ছোট ছেলে একটু নাড়ুগোপাল টাইপের । মাঠের রাফ অ্যান্ড টাফ ফুটবলের মধ্যে সে খুব একটা যেতে চায়না। ওরা একটা গোল দিলো , আর আমরা দুটো। আমাদের একটা গোল সৌভাগ্যবশত আমি করে ফেলেছিলাম। স্কোরলাইন 3– 2। আমরা পরিষ্কার হেরে গেলাম ।তার চেয়েও অপমানজনক ব‍্যাপার হল , পুজোর আগে বেধড়ক প‍্যাঁদানি খাওয়া । তাও আবার গঙ্গার ওপার থেকে এসে মেরে দিয়ে চলে গেল। ট্রফি হাতে ব্যাটাদের কি নাচ ! আমি ঘাসের উপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম । কমলদা পাইন অ্যাপেল জুসের বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল , পরের বছর দেখে নেবো। আর প্রোটেস্ট লেটার তো জমা দিয়েই এসেছি । তুই মন খারাপ করিস না। তবে তোকে পাড়ার ব্যায়াম সমিতিতে নিয়মিত যেতে হবে এবার থেকে । এমন ন্যাকা ন্যাকা চেহারা নিয়ে ফুটবল খেলা যায় না । যাক, ততক্ষণে বলাই দাস চট্টোপাধ্যায় সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। আমরা যেন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল এর খেলোয়াড় — ঠিক সেইভাবে মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি করমর্দনের জন্য । আমার কাছে এসে ওনার কী মনে হলো কে জানে ! গালটা আলতো করে টিপে বললেন , ফুটবল খেলায় ভয় পেলে চলে না। তুমি গোলকিপারকে ভয় পাচ্ছিলে কেন ? তুমি একাই তিনটে গোল করতে পারতে ! ভালো করে খেলো ! তোমাকে মোহনবাগানে নিয়ে যাব। তারপর সুন্দর একটা বিয়েও দিয়ে দেবো। আমি তো লজ্জায় টমেটোর মত লাল হয়ে গেলাম। বিয়ের কথা বলতেই আমার পাড়ার বান্ধবীদের কথা মনে হলো । কৃষ্ণা, বুড়ি, টুলটুলি । সবথেকে সুন্দর মুখের টুলটুলির কথা সবার আগে মনে হল ; যাকে নিয়ে আমরা ছড়া কাটতাম–
টুলটুলি নাকে দড়ি
কলতলাতে গড়াগড়ি..
ততক্ষণে পরিচয়পর্ব শেষ। আমাদের হাতে হাতে উঠেছে নিজদের ছবি সাঁটানো সার্টিফিকেট।
এখন এই মাঝরাত্তিরে পাড়ার মাংসের কালিয়া আমার বুক থেকে উঠে আসছে চোঁয়া ঢেকুর হয়ে। এত ভাল রান্নাও গুছিয়ে খেতে পারলাম না। বাবা শুধু বাড়ি ফেরার পর একটা কথাই বলেছিল, হেরে যাওয়ার কথা যেমন ভাববি না , হেরে গেলে আবার ভেঙেও পড়বি না। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের খেলায় তো যে কোন একটা দল হারে , একটা দল জেতে । তারপরের দিনই সবাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। সব খেলায় জেতা যায় না ঝন্টু। কিন্তু পিতাশ্রী ওই যে ছোট্ট একটা বাক্যবাণ কানের মধ‍্যে দিয়ে দিলে না , আমার দেবীপক্ষের শুরুটাই নিমপাতা হয়ে গেল । সন্ধেবেলার ফাংশনের শেষে বাবা সকলের সামনেই আমায় বলে দিল — তোর দ্বারা ফুটবলটা হবেনা । যে গোলকিপারকে ভয় পায় , আর যাই হোক না কেন , সে গোলকিপারকে বিট করে হেড করতে পারবে না । আর , মাথা যদি কাজে না লাগাতে পারিস এবং দুটো পা যদি সমান গতিতে না চলে , তাহলে ফুটবল খেলাটা শুধু ভয়ে ভয়েই কাটবে। সব সময় মনে হবে খেলাটা কতক্ষণে শেষ হবে ! এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেছিল।কখন হঠাৎ মাথায় দিদির হাত। মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাইরে তখনও চাল ধোয়া জলের মতো পাতলা অন্ধকার , আর আবছায়া। দিদি বলল — চল , ফুল পড়তে যাবি ? আমার চোখের জল বাঁধ মানছিল না। দিদির কাঁধে মুখ লুকিয়ে এবার সত্যি সত্যিই কাঁদলাম । বাবা নয়, মা নয় , দাদা নয়– দিদিই আমার সত্যিকারের বন্ধু । আমি কোনমতে জবাব দিলাম — চল…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।