সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ৭)

কেষ্টা এন্ড কোম্পানি.

এই তো সেইদিন সকালে বেশ ঝলমলে রোদটি ছিল. ক্লাস নেওয়া, দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে ধূপছায়া রঙের মেঘের দল চলে এল. আমিও পায়ে পায়ে ছাদে হাজির. এই মেঘেরা তেমন রাগী নয়. তাদের আড়ালে, আবডালে রোদ জড়ির আঁকিবুকি ছিল বৈ কি. আকাশে দৃষ্টি বিছিয়ে মাধবীলতা ঝাড়ের পাশে বসেছিলেম.
দাশু নেমে এল. আমি খেয়াল করি নি প্রথমে.
পরে দেখে লাফিয়ে উঠেছি.
‘কি রে হতভাগা, কতদিন পর’. বেশ প্রগলভ হয়ে পড়ি.
দাশু বলে ‘হুম’.
আমি আবার বলি ‘কোথায় ছিলি রে এতদিন’.
দাশু বলে ‘শোন তোর মত স্বপ্ন দেখে আর সংসারে দুটো ফুল, বেলপাতা গুঁজে দিয়ে আমার চলে না. আমার মেলা কাজ’.
হাড়পিত্তি জ্বালানো কথা শুনে মেজাজ গেল চটকে. আমি বললেম ‘ কে আসতে বলেছে?’
দাশু বলে ‘এই একটু জিরোতে এলেম’.
আমি আবার বলি ‘জিরোনোর জায়গা জোটে নি বুঝি কোন মুল্লুকে? এই আমার ছাদে আসতে কে বলেছে শুনি.’
দিব্যি হাওয়া দিচ্ছিল, মৃদু মন্দ, রোদ বাবাজী ফুরফুরে মেজাজে লুকোচুরি খেলছেন, আমি একটা ইজিচেয়ারে বসে সিয়েস্তার প্ল্যান করছি, এই দাশু ব্যাটা এতদিন পর আসবি তো আয় এসেই গা জ্বালানো কথা শুরু করলি.
মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকি. ধূর ছাই, দাশুকে দেখে খুশি হওয়াই উচিত হয় নি.
ঠিক তখনি বাঁশি বেজে উঠল. ও বাবা দাশু আবার বাঁশি বাজায় কবে থেকে. তেড়ে মুখ ঝামটানি দিতে যাব, দেখি দাশুর পাশে কেষ্টা বসে রয়েছে. আর দাশু তাঁর বাঁশির সাথে মাথা দোলাচ্ছে.
তা দাশু যখন কেষ্টাকে ধরেই এনেছে আমিও টপাটপ প্রশ্ন ছকে ফেলি. দাশু আমার মাইন্ড রিড করতে পারে. ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলে – ‘জিজ্ঞেস করে নে, যা জিজ্ঞেস করার, কেষ্টা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড’.
আমিও রাগ ভুলে এইবার গুছিয়ে বসি.
বলি ‘তা গুরু কেষ্টা, আমাদের উদ্ধার করতে কবে আসবে, শুধু বাঁশিটি বাজালে হবে?’.
ভুবনভোলানো হাসি হাসে কেষ্টা. তিনি জাত প্রেমিক কিনা. তারপর বলে ‘আমি তো কোথাও যাই নি সখী’.
আমি বলি ‘ন্যাকা মার্কা হাসি হেসো না. আর ওইসব সখী টখী বলে ডাকার কোন দরকার নেই. আমার অসহ্য লাগে’.
কেষ্টা আবার হেসে বলে ‘ওই তো অভ্যাস’.
আমি বলি ‘ওইসব অভ্যাস কদমতলায় রেখে এস, আমায় সোজাসুজি উত্তর দাও. এই রোগ, ভোগ মিটবে কবে?’
কেষ্টা বলে ‘বিজ্ঞানে ভরসা রাখ’.
এরপর তো আর কিছু বলা যায় না.
আমি কথা ঘোরাই, ‘বলি তুমি রাধাকে এত কাঁদিয়ে কি পেলে? মেয়েটাকে ফেলে রেখে চলে গেলে মথুরা, আর এলে না, এটা কেমন হল?’.
সে বললে. ‘সে তো আমার মন মালঞ্চে আছে, তাঁকে ফেলে কোথাও যাই নি তো, সে যে আমায় ছাড়তে জানে, তাই তো সে ফুলের সৌরভটুকুর মত হৃদয়ে রয়ে গেছে’.
‘রাই খাতিরেই একমাত্র
ত্যাগ স্বীকারে শ্যামেরা’ – কেষ্টা বলে ওঠে .
উ বাব্বা কেষ্টা যে দেখি শ্রীজাত শোনাচ্ছে.
আমি আবার প্রশ্ন হানি, ‘তা তুমি ত্যাগটা করলে কোথায়?’
‘চলে যাওয়াটাই দেখলে সখী, কষ্ট কি আমার হয় নি, আরো যে কত কাজ ছিল আমার’
এবার আমি চুপ করে যাই.
কেষ্টা বরাবর কথার জাদুকর. চিরকাল তাঁর হৃদয়ে রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে থাকে এবং সে রঙে সবার হৃদয় রাঙা হয়.
আমি পরের প্রশ্নে যাই ‘তোমার মধ্যে কি আছে গুরু? সত্যভামা, রুক্মিণী , ১৬০০০ সখী সবাই ফিদা হয়ে রইলেন, কেন? আর কৃষ্ণা পাঞ্চালী দ্রৌপদী? তিনি তো শুনেছি তোমারি অংশ.’
এ কথা বলার পরই কেষ্টা বাঁশিটি তুলে নিয়ে তাতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন, অমনি দ্রৌপদীর কেশরাজির মত পুঞ্জ, পুঞ্জ মেঘ নেমে এল আমার ছাদে. সেই পুঞ্জীভূত কেশরাশি আড়াল করলে কেষ্টাকে. বাঁশির সুরের খেয়া বেয়ে, মেঘের আড়ালে
আকাশ পথে পাড়ি দিল কেষ্টা আর দাশু.
দাশু শুধু যাবার আগে বলে গেল ‘প্রেম খুব জটিল রসায়ন, বেশি ভাবতে যাস না ওসব নিয়ে.’
আমি ভেব্লে গিয়ে একাই বসে রইলেম.
খানিক পরে ছাদ থেকে নেমে এসে টেবিল ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি ভাদ্রের তেরো তারিখ জন্মাষ্টমী, কেষ্টার জন্মদিন, আর দুদিন বাকি.
আর আমার লেখার টেবিলে আরও অনেক হাবিজাবি জিনিসের সঙ্গে ক্যালেন্ডারের সামনে পড়ে রয়েছে একটা ময়ূর পালক.
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।