“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় ইন্দ্রাণী ঘোষ

আষাঢ়ে গপ্প

মধ্যবিত্ত পাড়াতে এই দু হাজার কুড়ি সালেও হৃদ্যতা বর্তমান. আর এই পাড়ার মহিলাদের মধ্যে সখীত্ব মন্দ নয়. তা এই লক ডাউনের বাজারেও জনা পাঁচেক চল্লিশর্দ্ধ্ব মহিলা ‘আলাপন’ নামক একটি সংস্থা চালিয়ে থাকেন. নিজেরা রান্না করে পাড়ার বস্তির জিবীকাহারা মানুষগুলোকে একবেলা খাবার দেন. বাড়ীর পুরোন পর্দা, কাপড় চোপড়, ন্যাতাকানি বস্তির মেয়েদের জোগান দেন. তাঁরা সেই রঙীন ফাঁটা ছেড়া কাপড়গুলিকে জোড়া দিয়ে ব্যাগ বানায়. এই আলাপনেরই এক দিদি সেই ব্যাগ বিক্রীর ব্যবস্থা করেন. অনলাইন ব্যবস্থা. ও হ্যাঁ এই দিদিদের পরিচয় দেয়া হয় নি. এনারা হলেন দময়ন্তী, দৃপ্তি, মৃনালিনী, চিত্রাঙ্গদা, মধুব্রতা.
দময়ন্তী অধ্যাপিকা, দৃপ্তি ইস্কুলের দিদিমণি, চিত্রাঙ্গদা সফটওয়ার প্রফেসানাল, মৃনালিনী ও মধুব্রতা পুরোপুরি গৃহিনী. হাল ফ্যাসনের ভাষায় ‘হোমমেকার’. তবে এদের পাঁচজনের যেটি বন্ধনগ্রন্থি সেটি হল পরপকারের কিলবিলে পোকা এদের মাথায় সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর বয়:সন্ধির সময় ছেলেমেয়েরা যে যার মত পাখা মেলে দেওয়াতে এরা কিঞ্চিত একাকীত্ব কাটাতে এই ‘আলাপণ’ মহলের নিয়মিত সদস্যা. আসন বুনে, লেস বুনে, কুরুশের কাজ করে, সমিতির ভাড়ার চালু রাখেন এঁরা. সৃষ্টির জাল বুনে বুনে কখনো সাহিত্য সভা, নাচ গানের আসরও চালু রাখেন. মধুব্রতা নিয়মিত সমিতির এককামরা ফ্ল্যাটবাড়ীটি ধুঁয়ে, মুছে নিকিয়ে আল্পনা দিয়ে রাখেন. প্রতি সন্ধ্যায় ধঁুপ ধুনো দিয়ে পবিত্র করেন. মৃণালিনী রন্ধন পটিয়সী এই লক ডাউনের বাজারে একবেলা রান্নার ভার স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন. এই ফ্ল্যাটের মালকিন দময়ন্তী. স্বামী, সংসার থাকা সত্ত্বেও নিজের একটুরো মুক্তির আকাশের লোভে এই আস্তানাটুকু করেছিল সে আর আলাপনের জন্মলগ্ন থেকে এই এক কামরার আকাশটুকু সে তাঁর সইদের সাথে ভাগ করে নিয়েছে. আলাপনের যত আন্তর্জালীয় কাজ কর্ম দেখে চিত্রাঙ্গদা. বস্তিতে বা আশেপাশের এলাকা ঘুরে দু:খী মানুষদের খুঁজে বের করে তাদের জোর করে উপকার করার দায়িত্ত্বে দৃপ্তি .
তা সেদিন লকডাউনের চতুর্থ মাসে পা দিল এই দেশ. ইস্কুল কলেজের অনলাইন ক্লাস শেষ করে দময়ন্তী, দৃপ্তি হাজির ছটা বাজতে না বাজতেই. মধুব্রতা আর মৃনালিনী রান্না করা খাবার বিলিয়ে. এক কামরার ছোট্ট কিচেনে সবে চায়ের পাতা ভিজতে দিয়েছে. আজ দুপুর দেড়টার মধ্যে খিচুড়ি, লাবড়া তুলে দিতে পেরেছে তাঁরা অভুক্ত কিছু মুখে. বস্তির মেয়েদের আজ রঙীন কাপড় দেবার দিন ছিল. দেওয়া হয়ে গিয়েছে. আজ ঝঁাপ নামিয়ে চিত্রাঙ্গদাও হাজির. ঊইকেন্ড বিদেশি ক্লায়েন্ট কেটে পড়েছে তাড়াতাড়ি. গত মাসের ব্যাগ বিক্রীর হিসেবে যা পেয়েছে সমিতি তাতে বস্তিতে সকল মেয়েরা ৫০০ টাকা করে ঘরে নিতে পারবে. অতএব মেজাজ সকলেরি বেশ ফুরফুরে. পাঁচ সইতে গোল হয়ে ঘিরে বসে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দেয়, ভুরভুরে দার্জিলিঙ সুগন্ধীর সাথে আলাপচারিতাও ভুরভুর করে উঠে আসে. পাঁচজনেই বিবাহিতা, সন্তানের জননী অতএব সেই পুরনো কাসুন্দি, সেই রোজগার না করলে ‘পায়ের উপর পা তুলে’ আরামের খোঁটা নয় তো রোজগার করলে ছেলেমেয়েগুলোকে ছেড়ে কাজে যাবার সময় নিজেরই বিবেক দংশন. কথায় কথায় চড়মড় করে বাজ পরে বাইরে, ঝেঁপে বৃষ্টি আসে. দুম করে ছোটবেলার লোডশেডিং হাজির. কোনমতে হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেশলাই, মোমবাতি জোগাড় করে মৃনালিনী. দেশলাই ঘসে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে মনে পড়ে দৃপ্তীর একটা লন্ঠন রাখা আছে তো, এথনিক আর হাতের কাজের এক্সিবিশনের সময় রাখা হয়েছিল জোগাড় করে, কেরোসিন ভরা আছে. লন্ঠন বা হারিকেনের আলো জ্বেলে, খুব একপ্রস্থ হাসে পাঁচ জনেই, পরের মাসে ব্যাগ, মাস্ক, শতরঞ্চি, যথেষ্ট বিক্রি না হলে ‘আলাপন’ এর হাতে এই হারিকেন ধরাতে হবে. একবেলার লাবড়া খিচুড়ি বা ডিমের ঝোল ভাত, মাস গেলে ৫০০ টাকা কিছুই দেয়া যাবে না. আলাপনের সদস্যাদের চা বিস্কুটের খরচাটুকুও জুটবে না. সরকারী চাকরী দৃপ্তি আর দময়ন্তী দুজনের বাদ দিলে বাকি তিনজনের নেই. চিত্রাঙ্গদার আই. টি তো সবসময়তেই টলমলায়মান, কবে প্রজেক্টে তালা ঝোলে, মৃনালিনী, মধুব্রতা ভালবাসার শ্রমদানটুকু করা ছাড়া কিছুই করতে পারে না. সকালে সংসারের উনকোটি ঝামেলা সামলে এখানে এসে রান্না সেরে ঘর পরিস্কার করে, হিসেবনিকেশ বুঝে নিয়ে সন্ধ্যেয় বাড়ী ফিরে যাওয়া. আলাপন তাদের একমাত্র খোলা জানালা. কথায়, কথায় বৃষ্টি বাড়ে. আজ কি তবে আর বাড়ী ফেরা হবে না? যদিও সকলেরই বাড়ী পায়ে হাঁটা পথ তবু মনে মনে পাঁচজনেই চায় আজ বাড়ী না যেতে. লকডাউন খুললে পাঁচজনে মিলে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করে. এমন সময় দরজায় খুটখুট আওয়াজ হল যেন. সকলেই সজাগ হয়. নীচে সিকিউরিটি আছে কাজেই আলটপকা কেউ ঢুকে আসতে পারবে না. তাহলে এই কম্পলেক্সের কেউ হবেন. ইন্টারকমে ফোনও তো করে নি কেউ. হঠাৎ দরজাটা নিজে, নিজেই খুলে যায়. সেকি আজ তো আলাপনের পাঁচ সদস্যা ছাড়া আর কেউ আসে নি. দরজা খোলা ছিল, কেউ খেয়াল করে নি. হারিকেনের আবছায়াতে এক আপাদমস্তক ঢাকা নারী মূর্তি ঢুকে আসে. একি কে আপনি? পাঁচ সইতেই সমস্বরে জিজ্ঞেস করে. ‘ভয় পাবেন না দিদিরা, আমি এই কম্পলেক্সই থাকি, আপনাদের চিনি, আজ আপনারা একটু ফাঁকা আছেন বলে দুটো কথা কইতে এলেম.’পাঁচজনেই এবার নড়েচড়ে বসে বলে ‘ বলুন’. “আমার একটা উপকার করতে হবে দিদিরা’. কথায় পটু চিত্রাঙ্গদা এগিয়ে যায়. ‘বসুন, বলুন কি করতে পারি?’. গায়ের চাদরটি খুলে পাট করে ভাজ করে রাখেন ভদ্রমহিলা. ‘ইস আপনি একেবারে ভিজে গেছেন যে,’ মাতৃস্বভাবা মৃনালিনী বলে ওঠে ‘একটু চা খাবেন?’. ‘খেতে পারি’ বলেন আগুন্তুক অতিথি. রান্নাঘরে গিয়ে মোমবাতির আলোতে ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালে মৃনালিনী. বেশ খানিকটা কন্ডেন্সড মিলক ঢেলে দেয় চায়ে. কাপ প্লেট গুছিয়ে এনে দেয় অতিথিকে. বাকীরা তখন আলাপচারিতা জুড়েছে. ভদ্রমহিলা একাই থাকেন, স্বামী গত হয়েছেন, এই কম্পলেক্সের শেষ বাড়ীটার পাঁচতলায় থাকেন. ছেলে বিদেশে. আলাপনের কথা আবাসিকদের কাছে শুনেছেন, আজ তাই একটা উপকারের আর্জি নিয়ে এসেছেন. আঁচলের নীচ থেকে একটি চামড়ার ব্যাগ বার করেন তিনি, ‘এইটি নিয়ে আমার উপকার করুন’. ‘কি আছে এতে?’ দৃপ্তী শুধোয়. -” এক লক্ষ টাকা’, ‘আমার স্বামীর পাপের টাকা, অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছেন এককালে, আমিও তাদের মধ্যে একজন, আজ সেই পাপের টাকা নি:সহায়দের কাজে লাগুক’. ‘কি বলছেন আপনি?”, চমকে ওঠে পাঁচজনেই. ভদ্রমহিলার চোখদুটোতে মায়া মাখানো, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে দেখে বোঝা যায়. টিকালো নাক, টানা, টানা চোখ. পরনে কাপড়টি বেশ দামী. হাতের অনামিকাতে একটি সবুজ পাথরের আঙটি, কানে একই পাথরের দুটো সবুজ দুল. গায়ের রঙটি মাখনের মত হলদেটে পিচ্ছিল. পাঁচজনেরি কেমন মায়া জন্মায় ভদ্রমহিলা কে দেখে. তাঁরা বলে ‘আপনি তো এই কম্পলেক্সই থাকেন, আলাপ তো হয়েই গেল, আমাদের সাথে কাজ করতেই পারেন, আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে আপনি তো সবই জানেন. এখনই এতগুলো টাকা নাই বা দিলেন, আপনার মোবাইল নম্বর দিয়ে যান, আমরা যোগাযোগ করে নেব.’ কেমন যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে ভেঙেচুড়ে যায় ভদ্রমহিলার প্রতিমার মত মুখখানি, তারপরেই নি:শব্দে উঠে দাঁড়ান. চিত্রাঙ্গদা তাড়াতাড়ি মুঠোফোন বার করে বলে “নম্বরটা বলুন ভাই’. ‘৯৯০৩৯৩৯৮২০, বেশ আসি তবে”. ভদ্রমহিলা দরজা খুলে ধীর পায়ে মিলিয়ে যান অন্ধকারে. বিজলীও ফিরে আসে. ঘড়ি বলে রাত বারোটা. আকশে বিদ্যুতের লাস্য স্তিমিত হয়ে আসে, বৃষ্টিও ক্লান্ত হয়ে খুলে রাখে তাঁর হীরের অলংকার. আগুন্তুক বিষাদপ্রতিমার কথা বলতে বলতে, ম্যাগী দিয়ে ডিনার সেরে পরেরদিন সেই বিষাদপ্রতিমার খোঁজখবর নেবে ঠিক করে আলাপনের পাঁচ আলাপিনি. সেদিন রাতটা কথায় কথায় পার হয়ে যায়. পরদিন ভোরে পাঁচজনেই চটপট তৈরি হয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ায়. দরজার চাবি হাতে নিতেই কী হোল্ডারের নীচে চোখ পড়ে সবার. সে কি ভদ্রমহিলা টাকার ব্যাগটা সেই রেখেই গেছেন আর সাথে এক জোড়া সবুজ পাথরের দুল আর আঙটি , এত করে বুঝিয়ে বলা সত্ত্বেও, পাচজনের চোখের আড়ালে ঠিক রেখে গেছেন এসব.
পাঁচজনেই পা চালিয়ে নীচে নামে. সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে “ভাই শেষ বিল্ডিঙের পাঁচতলায় কারা থাকেন?” “কোই নেহি রেহতা দিদি, এক বুডঢা আদমী থা, শুনা থা, বহুত প্যায়সা বানায়া থা, তিন সাদী থা, দো বিবি কো খুন কিয়ে থে অউর তিসরিওয়ালি কো হামনে ভি দেখা থা, উসনে একদিন আপনে সোহারকো জেহের দে দি, অউর খুদ নে ভি জেহের পিকে খুদকুসি কর লি. তব সে মাকান বন্ধ পড়া হ্যায়, শুনহা হ্যায় কুছ দিন মে সরকার কব্জা কর লেগি, কিউ দিদি, কিউ পুছ রাহি হো আপলোগ? “.” এয়সেহি পুছা থা ভাই”, আর কথা বাড়ায় না আলাপিনিরা, চামড়ার ব্যাগটি বুকে আকড়ে কম্পলেক্স থেকে বেড়িয়ে আসে তাঁরা. বর্ষা রাতে দেখা দেওয়া বিষাদপ্রতিমার শেষ ইচ্ছেটুকু তাদের যে পুরোন করতেই হবে. সামনে অনেক কাজ তাদের.
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।