T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় ইন্দ্রাণী ঘোষ

দুই চোর আর দুই বুড়ির গল্প 

আশ্বিন মাসের ভোর বেলা, উঠোনে শিউলি গাছটার নীচে শিউলি ঝরে এক শুভ্র আসন বিছিয়ে রেখেছে । প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নেন মাধুরী দেবী । এ সময় রোজ ঘুম ভেঙে যায়, বড় আরামের সময় এটি । উঠোনে এসে দাঁড়ান, টবের গাছে জল দেন । একাই থাকেন মাধুরী দেবী, চারিদিকে আকাশঝাড়ু বাড়ীর মাঝে, এই উঠোন দেওয়া বাংলো প্যাটার্নের বাড়ীটি তাঁর বড় প্রিয় । হঠাৎ মাধুরী দেবী দেখেন সিরিঙ্গে মত দুটো লোক শিউলি গাছটার পেছন দিয়ে ফুরুত করে সরে পড়ল । উঠোনের চারদিকে পাঁচিল দেওয়া, তার মানে কেউ পাঁচিল টপকে ঢুকেছে । মাধুরী দেবী সজাগ হলেন । ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হচ্ছে । পরের কিছুদিন টানা বৃষ্টি চলাতে মাধুরী দেবী উঠোনে আসতে পারেন নি, বেশ কিছুদিন পর আবার ব্রাহ্ম মূহুর্তে আকাশ পরিস্কার হওয়াতে তিনি উঠোনে এসে দাঁড়ালেন । সেদিনও শিউলি তলা ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, আবার সেই সিরিঙ্গে মত লোকটাকে দেখতে পেলেন, সঙ্গে সেই স্যাঙাতও আছে । একজন তাকে দেখেই চোখের নিমেষে পাঁচিলে উঠে পড়ল, মাধুরী দেবী চিৎকার করে বললেন ‘এই তোরা আবার এসেছিস’, আরেকজন মাধুরী দেবীর চোখে চোখ রেখে বললে ‘উফফ তুমি আবার আজকে এই ভোরে উঠে পড়েছ, ধুর ছাই’ । এই বলে একেবারে কাঠবিড়ালির ক্ষিপ্রতায় পালাল পাঁচিল টপকে । মাধুরী দেবী এবার বুঝলেন এরা তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য রাখে । তিনি একাই থাকেন, স্বামী গত হয়েছেন, ছেলে মেয়েরা সবাই বিদেশে, মোকাবিলা তাঁকে একাই করতে হবে । ছেলেমেয়েদের বললেই তারা অযথা দুশ্চিন্তা করবে, কিছু তো করতে পারবে না । বরং একটু বেলা হল প্রীতিলতা কে ফোন করবেন । প্রীতিলতা তাঁর প্রাণের বান্ধবী, তাঁরই মত একাকিনী নিরভিমান নক্ষত্রের জীবন কাটান, বিয়ে করেন নি, মোটা অঙ্কের পেনশান পান, এন্তার বই পড়েন, দুই, তিনটে লাইব্রেরীর মেম্বার, ডিজিটাল লাইব্রেরীও ঘাঁটা হয়ে গেছে। সিরিঙ্গে ছেলেগুলোকে দেখে মাধুরী দেবীর কেমন মায়া হয়েছিল, পুলিশে খবর দিতে ইচ্ছে করল না ।
একটু বেলা হলে প্রীতিলতা কে তিনি মোবাইলে ধরলেন, প্রীতিলতা মন দিয়ে সব শুনে বললেন , ‘হুম, তার মানে আমার এখানে যারা এসেছিল, তারাই হবে’ । মাধুরী দেবী আকাশ থেকে পড়েন ‘তোর ওখানে মানে?’
‘হুম তোকে বলি নি, দুটো সিরিঙ্গে ছোকরা, সেদিন আমার ফ্ল্যাটে সেঁধিয়েছিল, আমার হাত, মুখ বেঁধে, বাসনকোসন আর কিছু টাকাপয়সা নিয়ে চলে যাবার সময় প্রণাম করে বলে গেল ” ‘ মাসীমা চাকরী পাই নি, তারপর কোভিডের পর ছোটখাট ব্যবসাও লাটে উঠল, তাই চুরি করতে বাধ্য হলাম, অপরাধ নেবেন না, হাতের বাঁধন আপনি একটু পরেই খুলে ফেলতে পারবেন’ । তা অবিশ্যি পেরেছিলাম নেহাতই নভিস ছেলেগুলো, থানা পুলিশ করতে মন চাইল না। ভাবছি কি করা যায় । মাধুরী দেবী ধপাস করে বসে পড়লেন । ‘কি করবি প্রীতি?, এবার তো ভয় করছে । ‘ ‘আহ মাধু, তোর এই ভয়, ভয় বাতিক আর গেলো না । নে দেখি রান্নাঘরে যা, অনেকদিন তোর হাতে পাঠার ঝোল খাই নি, জমিয়ে রাঁধ দেখি, আমি স্নান সেরে তোর ওখানে আসছি, সাতদিন তোর বাড়ীতে বডি ফেলে দেব’ ।
মাধুরী দেবী পাঁঠার ঝোল রাধলেন । ভাত বসিয়ে নিজে স্নান সেরে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন । প্রীতিলতা দেবী পৌঁছলে দুজনে খাওয়া দাওয়া পর্ব সেরে শোবার ঘরে এলেন । প্রীতি দেবী ভোজন রসিকা খাবার সময় বিশেষ কথা বলেন না, তাই মাধুরী দেবীও কিছু বলেন নি । খেয়েদেয়ে শুয়ে, সন্ধ্যের দিকে প্রীতি বললেন ‘মাধু রাতে আজ দুধ, খই খাব । খাওয়াটা জব্বর হয়েছে দুপুরে । তুই আজ রাত তিনটে নাগাদ মাংসটা ভালো করে ফুটিয়ে রাখবি, আমি গোবিন্দভোগ চাল এনেছি, ভোর চারটে নাগাদ ভাত বসাবি, যাতে সূর্য্যোদয়ের আগেই গন্ধটা সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে । মাধুরী দেবী বলেন ‘ তুই যে কি বলিস প্রীতি, মাথামুন্ডু বুঝি না, শেষ রাতে উঠে ভাত রাঁধব, মাংস বসাব । তোর মতলবখানা কি বলত?’
প্রীতিলতা বলেন ‘আহ, যা বলছি শোন । আমার মন বলছে হাতেনাতে ফল পাওয়া যাবে । চল আটটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়ি’ । মাধুরী দেবী বান্ধবীকে ঘাটালেন না । যা বললেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন ঠিক করে, আটটায় দুধ, খই খেয়ে শুয়ে পড়লেন । সেদিন রাত তিনটেতে উঠে মাধুরী দেবী সোজা রান্নাঘরে গেলেন বান্ধবীর কথা মত মাংস ফুটতে দিয়ে, গোবিন্দভোগ চালের ভাত চাপালেন । প্রীতিলতা বললেন ‘রান্নাঘরে তালা দিয়ে তুই ঘরে যা’, এই বলে নিজে ঊঠোনে লেবু গাছের আড়ালে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে রইলেন ।
শরতের পূর্নিমা রাত, চারিদিক জ্যোৎস্নার আলোয় ফিনিক ফুটছে । এমন সময় দুটো সিরিঙ্গে ছায়া উঠোনে পড়ল, প্রীতিলতা সজাগ হলেন । ছায়ামূর্তি দুটো পাঁচিল টপকে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেল, নিমেষে তালা ভেঙে তাঁরা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল । প্রীতিলতা পা টিপে টিপে এসে রান্নাঘরের শিকল তুলে আরেকটা তালা লাগিয়ে দিলেন । ঘরে এসে মাধুরী দেবীকে বললেন ‘চল চক্ষু সার্থক কর’ । দুই বান্ধবী রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দেখলেন দুই সিরিঙ্গে রাক্ষস মাংস আর ভাতের হাড়ী নামিয়ে চার হাতে মাংস আর ভাত খাচ্ছে ।

এরপর আর কি হয়েছিল জানি না । তবে শুনেছি স্টেশনের কাছে একটা মাটির দেওয়াল আর টিনের চাল দেওয়া ভাতের হোটেল হয়েছে নাম ‘মাধুরীলতা ভাতের হোটেল’ । এই হোটেলের দুজন মালিক বুড়ো মানুষদের প্রয়োজনে রাতে বিরেতে হাজির হয় এবং প্রাণ দিয়ে সেবা করে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।