রম্য রচনায় ইন্দ্রাণী ঘোষ

এমপ্লয়মেন্ট – ২৪/৭, সাতকাহন 

সংসার নামক যাঁতাকল একালেও আছে সেকালেও ছিল । সেই যাঁতাকল ঘোরান বিনা বেতনের কোন কর্মচারী । দিন নেই, রাত নেই সেই যাঁতাকল ঘরঘর শব্দে ঘুরেই চলেছে । এই সংসার চক্র যারা চালান তাঁরাই গৃহবধু, বিনা বেতনের কর্মচারী । তবে হ্যাঁ তাঁরা নিজেরাও বেতনের পরোয়া করেন নি । একনিষ্ঠ ভাবে সেবা করে যাওয়ার মন্ত্রে দিক্ষীত ছিলেন । রামমোহন , ঈশ্বরচন্দ্রের কৃপায় এদের জীবন উন্নত হয়েছে উনবিংশ শতক থেকেই । লেখাপড়া শেখার দরুন এদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়েছে । এরপর এরা সংসার পালন করেছেন প্রাণ দিয়ে । আশির দশকের গোড়া অবধি বেশিরভাগ সংসারেই গ্যাস, ফ্রিজ কিছুই ছিল না । রাবণের চূলোর মত গোটা চারেক চূলো হা হা করে জ্বলত । শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ভোর পাঁচটার মধ্যে স্নান সেরে এরা হেঁসেলে ঢুকে পড়তেন । ওই রাবণের চুলোয় আগুন দিতেন । বাড়ীর কর্তা মা পুজো সেরে হেঁসেলে ঢোকার আগেই চূলোর আগুনে চায়ের জল চেপে যেত। অন্তত পনেরো কাপ চায়ের জল একবারে চেপে যেত, বৌমাদের এমনই হুকুম দেওয়া ছিল। আমিষ, নিরামিষের হেঁসেল আবার আলাদা ছিল । গল্প হলেও সত্যির কোন রবি ঘোষ এদের উদ্ধার করতে আসতেন না । তারপর একেকজন বৌমাদের দ্বায়িত্ব ছিল একেকরকমভাবে কুটনো কোটার । ঝোলের আলু ডুমো ডুমো করে, ভাজার আলু ঝিরি ঝিরি করে, ঘন্টের আলু লম্বালম্বি কাটা হত । বেগুন, কুমড়ো, পটল, পদের রকমফেরে কাটা হত । ভাতের পাতের তরকারি কাটিং আর জলখাবারের সবজির কাটিং আলাদা হত । চা, জলখাবারের পর্ব মিটলে ভাতের পর্বের শুরু । জল খাবার ব্রেড অমলেট, দুধ কর্নফেক্স নয় । রুটি বা লুচি বা পরটার সঙ্গে তরকার এবং মিষ্টি থাকতেই হত । শীতকালে দুধ, খই, গুড় দিয়ে চলতে পারত । পিঠের দিনে পিঠেও চলত ।
এক গৃহিণীর মুখে শুনেছি ‘অফিসের ভাত’ বলতে একটা বিশেষ শব্দবন্ধ ছিল । অর্থাৎ কিনা বাজার করে নটায় ঢুকবেন কর্তা, বাজারের থলিটি নামিয়ে স্নান করতে চলে যাবেন । কর্তার স্নান সারা হতে হতে মাছ ধুয়ে, ভেজে, ঝোলে দিয়ে ভাতের সাথে পরিবেশন করে দিতে হবে । কর্তার আহার হবে ‘স্ট্রেট ফ্রম দ্য অভেন’ । কি অসম্ভব তৎপরতায় এসব তাঁরা সামাল দিতেন ভাবলে অবাক হতে হয় । এই দশটার পর্ব মিটলে গৃহিণীদের জলখাবারের পাট থাকত। তারপর কাচাকাচি, বড়ি দেওয়া, আমসত্ব দেওয়া, চাল বাছা, ইত্যাদি প্রভৃতি । যাদের বাড়ীর কর্তারা আবার দুপুরে খেতে আসতেন তাদের না খাইয়ে এনারা খেতে বসতেন না । অনেক সময়তেই গৃহিণীদের ভাতের জল কেটে যেত । সু্য্যি পাটে বসার সময় হয়ে যেত এদের কাজ ফুরোতে চাইত না ।
আত্মীয় পরিজন আসার কোন শেষ সীমানা ছিল না । আমার মা, ঠাকুমা, মাসি, পিসি, মামীদের দেখেছি তাঁরা যা রান্না করতেন এবং করেন বলে বলে ৬ বালিগঞ্জ প্লেস, আহেলী, তেরো পার্বণ কে ৭ গোল দেবেন । আমি আজ অবধি খুব ঠেকে না গেলে খেতে যাই নি এসব পাঁচ তারা জায়গায়। অত্যন্ত স্বল্প উপকরণে, তাঁরা যে কি অসামান্য রেঁধে ফেলতে পারতেন এবং পারেন তা ভাবনার অতীত । কুমড়ো ফুল ভাজা আর ডাল দিয়েই খাওয়া হয়ে যেত কত সময়, সে ডালের এমন স্বাদ হত । শুধু আদা, জিরে, ধনে বাটা দিয়ে অমৃতসম ডিমের ঝোল, মাছের ঝোল নামিয়ে দিতে পারেন ।

তখনকার গৃহিনীদের সংসারে অসময়ে আত্মীয় পরিজন এসে পড়লে তো নিজের ভাগের ভাতটুকুও দিয়ে দিতে হত । আত্মীয়, অনাত্মীয়ের মা বাপ হারা কত শিশু এদের ছায়ায় বড় হয়ে যেত । বিকেলের জলখাবার, রাতের রান্নার ব্যবস্থাও একই তৎপরতায় করতে হত । এতসবের বিনিময় এদের ভাত কাপড় আর মাথার উপর ছাদ জুটত । প্রেম নামক মহার্ঘ্য বস্তুটি কতজনের কপালে জুটত জানা নেই । তবে কয়েকজন মায়ের সুপুত্তুর মায়েদের চোখ এড়িয়ে বৌদের খোঁপায় ফুল গুঁজে দিতেন । কখনও সখনো বেলফুল কাঁচের প্লেটে জলে ভিজিয়ে রেখে দিতেন শোবার ঘরে । এইসব গৃহিণীরা উবু করে খোঁপা বাধতেন, উচু করে শাড়ী পড়তেন, ঘরে পরতেন ছাপা শাড়ী, বাইরে কোথাও গেলে (বাইরে বলতে অবরে সবরে বায়োস্কোপ, মন্দির বা কালেভদ্রে বাপের বাড়ী) তসর বা গরদ পরতেন । প্রসাধন বলতে পন্ডস কোল্ড ক্রীম আর সিঁদুরের টিপ । হাতে শাখা পলা, নোয়া । তাতেই তাদের কি সুন্দর দেখাত । ছুটি কাটাতে হয়তো ১০ বছরে একবার ওই দীঘা, পুরী বা দার্জ্জিলিং, তাও পরিবারের অন্তত কুড়ি, পঁচিশ জন মিলে । তাতে তাদের কোন আপশোস থাকত না । অনেক সময় সব দায় দায়িত্ব শেষ করে কর্তা গিন্নীকে নিয়ে কাশীবাসি হতেন, তবে সেটা খুব বেশিজন নন । সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকার মধ্যে অদ্ভূত তৃপ্তি থাকত তাদের । আজ আমরা বলছি তাদের গৃহিণী ভাতা দেওয়া হত না কেন, তাঁরা নিজেরা ভাবতেও পারতেন না কোন ভাতার কথা । তাদের শ্রমের যে দাম হয় তাই জানতেন না বা জানার প্রয়োজন বোধ করতেন না । উপরন্তু বাড়ীর পেছনের জমিতে শাক, সবজি, ফলমুল ফলিয়ে বাজার খরচ বাঁচিয়ে দিতেন । সংসারের টাকা হাতে পেতেন না । নিজেদের পয়সা বলতে কিছু জানতেন না অনেকেই । কেউ কেউ অবশ্যি লক্ষীর ঘটে পয়সা ফেলতেন, সিকি বা আঁধুলি কুড়িয়ে পেলে,বা বাপের বাড়ী থেকে কেউ উপহার দিলে, বা পুরোন খবরের কাগজ বিক্রী করে। যাদের গয়নাপত্র থাকত তাঁরা শুনেছি ননদের বিয়েতে বা সংসারের অসময়ে সেসব অকাতরে দিয়ে দিতেন । না, কোনদিন তাদের বেশিরভাগকেই অভিযোগ করতে, গৃহিণী ভাতা বা ‘হাউস ওয়াফ’ এলাওয়েন্সের কথা বলতেও শুনি নি তো । তবে একটা কথা ঠিক এই জাতাকল ঠেলতে ঠেলতে জীবনে পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে যেত । ছবি আঁকার পাতায় হলদে হলদে ছোপ পড়ত, কবিতার খাতায় অনুভতির জমাট শ্যাওলারা শোভা পেত, গানের খাতা হারিয়ে যেত। স্বামী নামক জীবটিকে অসহ্য লাগত।

এখন অবিশ্যি সময় বদলেছে । এখনকার মেয়েরা উমেন এম্পাওরমেন্ট নিয়ে সচেতন । তাঁরা গৃহবধু হলেও স্বেচ্ছায় হন । সংসারের জাতাকল তরতরিয়ে চলে । ছোট পরিবারে রাজনীতির স্যাঁতস্যঁাতে আবহাওয়া নেই বরং চৌখুপি বারান্দায় বসে রোদ্দুরের ওমে পিঠ ঠেকিয়ে ভুরভুরে দার্জ্জিলিং চায়ের খুশবুর সুখ আছে । ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব আছে । কোথায় টিউশান, কোথায় ওপেন হাউস, কোথায় পেরেন্ট টিচার্স মিটিং এটেন্ড করা আছে । খেলতে নিয়ে যাওয়া আছে, নাচের স্কুল, গানের স্কুল, সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাওয়া আছে । শ্বশুর, শাশুড়ির ডাক্তার, বদ্যি আছে । গ্রোসারীর ডিস্কাউন্টের খোঁজ আছে । বাড়ীর লোন নিয়ে বর বাবাজী যাতে কটা সই করে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাই জন্য ব্যাঙ্কে সব হ্যাপা সামলে, দরকার হলে অন্য রাজ্যের স্থানীয় ভাষা শিখে, সে ভাষা একদম গড়গড় করে বলে, সব ব্যবস্থা করে দেওয়া আছে । ফেসবুক, ওয়াটস আপ আছে । ইউটিউব দেখে নতুন রেসিপি ট্রাই করা আছে । সপ্তাহ শেষে বর, ছেলে, মেয়ে বগলে শপিং মল আছে, পার্ক আছে, রেস্তোরা আছে । মধ্য হপ্তায় ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ী গিয়ে সুখ দু:খের কথা বলা আছে । ছেলেমেয়েদের বন্ধুদের মায়েদের সাথে সই পাতিয়ে কলেজের দিনে ফিরে যাওয়া আছে । টুকটাক শাড়ী, গয়নার ব্যাবসা আছে । নিজের ফ্ল্যাটের এক চিলতে রান্নাঘরে পপ আপ কিচেন করে জনা পঞ্চাশের কন্টিনেন্টালের, মোগলাইএর বা পূর্ব বাংলার হারিয়ে যাওয়া রেসিপি রিসার্চ করে, বার করে, পার্টি অর্ডার নামিয়ে ফেলে, তাক লাগিয়ে দেওয়া আছে । নাচ, গান, আঁকা শেখানো আছে । মেক আপ আছে, শাড়ী কেনা আছে । বর, বাচ্চাদের মাসে একবার ট্রিট দেওয়া আছে নিজের রোজগারের পয়সায় ।
এরপর যদি কোন অনামুখ মিনসে বলে ‘মূল রোজগার বরকে দিয়ে করিয়ে, ঘরের কাজ কাজের মাসিকে দিয়ে করিয়ে নিজে হাওয়া খেয়ে বেড়াও ।’ তাহলে তিনটি উপায় আছে।
১. প্রেমে গদগদ হয়ে ‘আমি হেরেই যেতে রাজি’ গাইতে গাইতে সেই মিনসের কঁাধে মাথা রাখা আছে।
২. ‘কুচ তো লোগ কহেঙ্গে’ গাইতে গাইতে ছাদে চলে যাওয়া আছে।
৩. তাঁকে মূড়ো ঝ্যাটা দিয়ে দু ঘা বসিয়ে দেবার কলজের জোরও আছে।

এই কথা বলে এমপ্লয়মেন্ট ২৪/৭ এর সাতকাহন শেষ করলাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।