মেই লিং এর বাড়ীটি সুন্দর. এই এত প্রাচীন গলির ভিতরে এত সুন্দর বাড়ী থাকতে পারে কে জানত. বাড়ীর সামনের দরজায় বসানো রঙীন কাঁচ. তারপর একটা সরু প্যাসেজ, সেই প্যাসেজে রঙীন কাঁচের ছায়া পড়েছে. প্যাসেজ পেরিয়ে বসবার ঘর. সাবেকি আসবাবে ঠাসা. মেঝেতে পুরু কার্পেট. আর দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো চেষ্ট অফ ড্রয়ারের উপরে তথাগত বিরাজমান, তাঁর দুপাশে দুটি লাল রঙের ড্রাগন. নীচের দিকে রাখা একটি চৈনিক ক্যালেন্ডার ও একটি গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার. অর্থাৎ বাড়ীর বাসিন্দারা দুটি ক্যালেন্ডার পাশাপাশি মেনে চলেন.
ঝোরাদের টিমকে বৈঠকখানাতে বসিয়ে ভিতরে যান মেই লিং, ফিরে আসেন তিনটি ফ্রেশ লাইমের গ্লাসভর্তি ট্রে নিয়ে. ছোটখাট মহিলা. মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা. হাল ফ্যাসনের পিক্সি কাট যাকে বলে. পরনে জিন্স ও ফিগার হাগিং টি শার্ট. চোখ দুটি অসম্ভব উজ্জ্বল. ‘বলুন কি করতে পারি আপনাদের জন্য’.
বলেন মেই লিং. ঝোরা বলে ‘ চাইনীজ স্ক্রোলের উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে চলেছি আমরা, টিবেটিয়ান স্কুল অফ এন্থ্রপোলজির জন্য, সে বিষয়ে কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে. তথ্যচিত্রটি টিবেটিয়ান স্কুল অফ এন্থ্রপোলজির আরকাইভে থাকবে. আপনার তো কিউরিও এবং স্ক্রোলের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, সে বিষয়ে আমাদের ডকুমেন্টারীতে আপনার ইন্টারভিউ রাখতে চাই’. মেই লিং এর চোখ দুটিতে খুশি উছলে পড়ে ‘ আমি আপনাদের সব রকম সহযোগিতা করতে রাজি’. ‘বেশ খুব ভালো কথা’ আমি কিছু প্রশ্ন আপনার কাছে রেখে যাব, আপনি উত্তর তৈরি করে রাখবেন. আমরা এরপরে ডেট ফিক্স করে আপনার এবং আপনার কমিউনিটির কয়েকজনের ইন্টারভিউ নেব. আর কাকে আপনি রেকমেন্ড করবেন এই ডকুমেন্টারির ব্যাপারে সাহায্য করতে? আর আপনার কিউরিও এবং স্ক্রোলের কালেকশন আজ একবার দেখতে চাই. কয়েকটা স্টিল ছবি আজকে নিতে পারলে ভালো হয় ‘.” স্বচ্ছন্দে’ বলেন মেই লিং
” বাহ আপনি তো দারুন বাংলা বলেন’. ঝোরা বলে.
‘কলকাতায় জন্ম কর্ম বাংলাকেই তো নিজের ভাষা বলে জানি, ছোটবেলাতে চাইনীস স্কুলে গেছি, তারপর লোরেটোতে পড়েছি. স্কুল পাস করার পর বাবা পাঠিয়ে দিলেন শান্তিনিকেতনের চীনা ভবনে. বাড়ীতে ভাষা চর্চা করতেই হত. বাবা করাতেন. সেই ভাষার প্রতি ভালবাসা থেকেই শান্তিনিকেতন যাওয়া মূলত: ভাষার প্রতি ভালবাসা থেকেই, স্ক্রোলের প্রতিও ভালবাসা. ব্যাবসা শুরু করি চিনা ভবন থেকে পাশ করার পরই, ৫০ বছরের উপর বয়েস হল এখনো চালিয়ে যাচ্ছি. ছেলে অবশ্য কানাডা চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে. আমি যাব না কোথাও. যতদিন বাঁচি এখানেই থাকব’. ‘আপনার তো রেস্টুরেন্ট আছে শুনেছি’. ‘আমার স্বামীর, উনি মারা যাবার পর, আমি ব্যাবসা গুটিয়ে ছোট করে এনেছি, এখন শুধু সপ্তাহশেষে দুদিন খুলি, ছেলে চলে যাবে কানাডা, আমি একা মানুষ কতদিক সামলাব’.’স্ক্রোলের কালেকশন আজকে দেখা যাবে একটু? কয়েকটা স্টিল আজকেই তুলে নিতাম আমরা.’ নিশ্চয়ই তার আগে সামান্য অভর্থনা করার সুযোগ দিন,’ কথা শেষ করে হরিণ পায়ে ভিতরে চলে গেলেন মেই লিং, ফিরে এলেন ট্রলি ভর্তি চাইনীজ খাবার নিয়ে. চীনে খাবারের গন্ধে ক্ষিদেটা বেশ চাগাড় দিয়ে উঠল, ফোটোগ্রাফার ছেলেটিকে প্লেটে খাবার তুলে দিলেন মেই লিং. ঝোরার হঠাৎ খেয়াল হল অপূর্বকে দেখতে পাচ্ছে না তো. এতক্ষন কথপকথন চলল,সত্যি তো ছেলেটা গেল কোথায়
ঘাড় ঘুরিয়ে ঝোরা দেখল, চেষ্ট অফ ড্রয়ারের উপরে রাখা তথাগতর মূর্তির সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব. পায়ে পায়ে ঝোরা এগিয়ে যায় অপূর্বর কাছে. হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করা, চোখ বুঁজে রয়েছে অপূর্ব. এ তো মহা মুশকিল, ডকুমেন্টরির ব্যাপারে এ ছেলে কিছু জিজ্ঞেস করবে নিশ্চয়ই. কাজ করতে এসে এমন ভাবসমাধি হলে তো বিপদ. ঝোরা নিজেও যে বাস্তবে থাকে সবসময় তা নয়. তবে এখন তো কাজ করতে হবে. আলতো করে অপূর্বর কাঁধে হাত রাখে ঝোরা. আস্তে করে বলে ‘চল কাজ আছে স্ক্রোলগুলো আজই দেখে নেবে একবার, তুমি অনেক ছোট আমার মেয়ের বয়েসী হবে তাই বলছি, কাজে এসেছ, আগে কাজটা সেরে নাও’.
ঝোরার কথা শুনে, ঝোরার সাথে চলে আসে অপূর্ব, মেই লিং খাবারের প্লেট তুলে দেন অপূর্বর হাতে. অতীব উপাদেয় নুডলস, চিলি চিকেন, এসপারগাস আর স্পিনাচ ফ্রাই, অল্প করে সব প্লেটে নিয়ে নাড়াচাড়া করে অপূর্ব. এই বয়েসী ছেলে চাইনীজ খাবার এই ভরদুপুরে সামনে পেয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে কেন? ফোটোগ্রাফার ছেলেটি তো মহানন্দে খাচ্ছে আর মেই লিং এর সাথে গল্প জুড়েছে. ঝোরা খাওয়া শেষ করে মেই লিং কে বলে “চলুন এবার স্ক্রোল গুলো দেখে নি’.