সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে হেমন্ত সরখেল (পর্ব – ১২)

তাপ-উত্তাপ

পর্ব – ১২

ব্যাঙ্কে কথা বললো নিত্য’দা | ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে নিয়ে একদিন এসে মাকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্ম আর লোনের কাগজে সাইন করিয়ে নিয়ে গেল | সেদিন বিডিও অফিসে ছিলাম ভোটার লিস্টের কাজে | রতনদা দু’দিনের জন্য কোলকাতায় গেল | পার্টি জানলো রতনের হাত দিয়ে রিজাইন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি আমি | সবটা গুটিয়ে রতনদা ফিরে এল | একটা ঘর তুলছে শ্যামল বাড়ির দক্ষিণ পোতায় | মায়ের কেন জানি মনে হলো, এটাই ঠিক হবে |
রেল লাইনের পাশে অনেকটা খালি জমি | সেখানে ব্যানার্জী বাড়ির ব্যবসার ম্যাটেরিয়াল পড়লো | পাতু’র দোকানের পাশের ডোবাটা বাঁওরের সাদা বালিতে ভরাট হয়ে সেখানে ব্যানার্জী বাবুর দোকান আর অফিস | ব্যানার্জী বিল্ডার্স এন্ড জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার| পি.ডব্লিউ.ডি.- তে কন্ট্রাক্টর হিসেবে সেকেন্ড ক্লাস রেজিষ্ট্রেশন | প্রোপাইটার ছন্দা ব্যানার্জী | লেবার লাইসেন্স, প্যান কার্ড, সেল ট্যাক্স, ইঞ্জিনিয়ার সব ব্যবস্থা দেখলো খালেক | সাথে থেকে বুঝে নিলো সবটা রতনদা | কর্তা দোকানে হিসেব দেখবেন, রতনদা সাইট, অফিস, লেবার কমিশন, আরও যেখানে যা করতে হয় | পাওয়ারের হাত যে কোন ঠাকুরের থেকে বড়ো |
বাড়ির টেলিফোনটা দোকানে লাগানো হলো | ঘরটা সম্পূর্ণ না হওয়া অব্দি এখানেই | সন্ধে সাতটায় কর্তাবাবু হাঁটতে বের হন | ততক্ষণে পায়ের তলার সর্ষে গুটিয়ে হাজির রতনদা | আমার টাইম আটটায় | টেলিফোনটা এরপর থেকেই বাজতে শুরু করে | পাতু’র দোকানের চায়ের বিল গড় ধরলে তিরিশ টাকা হচ্ছে | বাবা থাকলে প্রায়ই পুরোনো কাকুদের দেখা পাই | দোকানে এসে বসেন | দুধ সাদা টিউবের আলোয় টেবিলের ওপাশে বসেন মালিক | বন্ধুরা এপারে | শিলিগুড়ি গামা কাঠের চেয়ার | টেবিলের কাঁচের নিচে সপার্ষদ বিবেকানন্দের একটা কাগুজে ছবি | পেন স্ট্যান্ড, এল. আই. সি-র মাসে মাসে উল্টে যাওয়া দিনপঞ্জি | বন্ধুদের সাথে গল্পের কালে কনুই দুটো উঠে আসে টেবিলের কাঁচের ওপর | আবার ব্যবসা সংক্রান্ত কথায় টান হয়ে বসে নির্মেদ শরীর | বাঁ হাত গাঢ় বাদামি চেয়ারের হাতলে, ডান হাত পাক দেয় কাঁচের পেপারওয়েট | কাঁচে কাঁচে ঘর্ষণের শব্দ হয় কি?এ কথাগুলো আমায় শোনানোর সময় রতনদা সেটা বলেনি | আমার মনে হয়, হয় | নইলে এত পুরোনো বন্ধুদের কাছেও ব্যবসার কথায় কর্তার রূপ বদলে যাবে কেন ? কী কী গল্প হয় বন্ধুদের মধ্যে? গল্প? সে হরেক রকমের গল্প | তাদের শাপলা-শালুক, গেঁড়ি-গুগলি, কাঁকড়া-বাইন, পদ্মকোরকের স্মৃতি, ডিঙি বেয়ে বিলে মাছ ধরতে যাওয়া নিত্য দিনের প্রসঙ্গ | লাহা বাবুর মনে হয় স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে | এক সাথে খেলে বেড়িয়েও আজকাল প্রসঙ্গে যোগ দিতে সোৎসাহে কল্পনা মিশিয়ে ফেলেন | বন্ধুরা সন্দিহান হয়ে সেখানে ঘটনার সঠিক ঘটনায় একমত হলে তিনি বলেন – ও, তাহলে তোরাই হয়তো ঠিক বলছিস, আমার আজকাল কেন জানি ও দিনগুলো আবছা হয়ে আসে | ওনার মা মরা ছোট ভাইটাকে পুলিশ নকশাল বলে তুলে নিয়ে যায় | অনেক দৌড়-ধূপ করেও জানতে পারেননি তাকে কোন জেলে রাখা হয়েছে | ওনার দৃঢ় বিশ্বাস,ওনার ‘অতিসাইরা’ বৌ-টাই পুলিশকে ছোট দেওরের মিথ্যে খবর দিয়েছে | ধান কলোনির ভাঁট আর চিড়চিড়ি, চোতরাপাতার জঙ্গলে বাঁওড়ের সাদা বালির পেটে সরকারি নিরানব্বই বছরের লিজ-এ ‘কম-বেশি’ চার কাঠায় হক ছিল তারও | সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হয়তো চিরকালের মতো তাকে সরিয়ে দিয়ে চার কাঠা নিজের দখলে রাখলো লাহা গিন্নি | – ‘অতিসাইরারে ঝোলায় ন্যায় না ক্যান’- তার উত্তর ওনার কাছে নেই | বন্ধুদের মুখ দিয়ে তখন কথা সরে না | দোকানের পেছনে ডাকা ঝিঁঝিঁ-র একটানা ডাক খুব জোরে শোনা যায় সে সময় | ঝমঝম করে ট্রেন চলে গেলে কথা পাল্টে কর্তাবাবু সকলকে হাসাতে চেষ্টা করেন | এ সময়গুলোয় মৃদু নিশ্চল হাসি কর্তার মুখে ভাসে আজকাল | ভালো লাগে শুনে | শুধু, তারা কিভাবে কিশোর থেকে এক লাফে প্রৌঢ় হয়ে গেছেন, সে রাস্তার গল্প কেউ করেন না | হয়তো, করতেও চান না | লাহা বলেন, থাকলে, কাল আসবো | সভা ভেঙে যায় আবার আগামীকাল বসবে বলে |
চষে ফেলার কাজ চললো বারোটা ওয়ার্ড | টিম, সাব-টিম, ফরে’দের টিম | সংবাদ সব আসা চাই | প্রতিটা নিঃশ্বাসের খবর চাই | পরিচিতি তো ছিল তবে জি.এস. থাকার সুবাদে পরিচিতিটা এভাবে ছড়িয়েছে সেটা প্রাত্যহিক পরিক্রমা না করলে জানতেই পারতাম না | হোমওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক বস্! যার যত সূক্ষ্ম ভাবে এ কাজটা করে ফেলায় দক্ষতা থাকবে, তার তত বেশি সাফল্যের সম্ভাবনা | সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ | যতই সাম্যবাদী বিদেশি তত্ত্বের পোষক হিসেবে মঞ্চ গরম করি না কেন,একটা কথা সকলেই মানি, কাজ গুছিয়ে আনতে এ চারটে ছাড়া উপায় নেই | নিঃশঙ্ক হতে হলে, নিরবিচ্ছিন্ন নিরঙ্কুশ হতে হলে ভাঙো বিরোধী জনমত | সোজা গিয়ে ঠেলে ওঠো তাদের দাওয়ায় | গামলায় একসাথে বসে কাঁচা তেল-পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখা খাও | খাও কম, দাঁত ম্যালো বেশি | তাদের এই অচম্ভিত অবস্থার সুযোগটা ক্যাশ করো | তুলে নাও খেলার রাশ নিজের হাতে | সাম আনো প্রথমে, বলো- তাদের সমান তুমি, চরিত্র, মননে,চিন্তনে | বলো- তুমিও শিকার অব্যবস্থার | অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, ওটা কেড়ে নিতে হয় | আর কাড়তে হলে এ সিস্টেমের মধ্যে ঢুকতে তোমাকে হবেই | সাম-এর টানে কিছু কই ঝাঁক ভেঙে আসবে | তাদের হাতিয়ার করো, বন্ধুদের বোঝাতে বলো, তোমার চলুক হোমওয়ার্ক | এবার ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দাও কিছু দাম | এবার তুমি সমান সমান | বেরিয়ে আসুক এবার দণ্ড, খোঁজ রাখো ব্যক্তিগত হিংসা, ক্ষোভ | তাপ বাড়াও, বাড়াতে থাকো উত্তাপ | দণ্ডের প্রয়োজনীয়তার মন্ত্রণাসভায় বলো-ব্রুটের সাথে ব্রুটাল অ্যাসাল্টে কোনো দোষ নেই |
রোগ বুঝে ডোজ ঠিক করো | করো হোমওয়ার্ক | যেখানে ইন্সট্যান্ট কাজ চাই, হোক অ্যালোপ্যাথি, একটু জটিল কেস, বারে বারে ডোজ, হোমিওপ্যাথি | কিছু আছে-সেরে গিয়েও ফিরে ফিরে আসে, অনুপান বুঝিয়ে ব্যাপারটা ছেড়ে দাও অ্যাকশন টিমের হাতে | যত্নে সেরে নেওয়া হোক আয়ুর্বেদিক | তুমি শুধু উত্তাপ বজায় রাখো | খিচুড়ি নেমে আসবেই গমের |
তুমি এক তৃতীয়াংশ | শেষ যারা রয়ে গেছে ওধারে, তারা যোগীর জটা | কিছু সূঁচ ছেড়ে রেখে দাও | তারা ঢুকবে কোন একদিন | একটা একটা করে খুঁটি নাড়াবে | তারপর…
‘ হ্যালো…’
‘ তুই দোকানে?’
‘ হ্যাঁ |’
‘ থাক, আসছি |’
সারাদিন কম ধকল যায়নি | চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলাম | প্রশ্ন নিয়ে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে রতনদা | ভাব দেখে হাসি পেয়ে গেল |

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।