সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৩)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৬৫
চোখের সামনে কথাগুলো কেমন যেন ভেঙে ভেঙে যায়। কথার শরীরে লেগে থাকে গুঁড়ো গুঁড়ো আস্তরণ। অথচ এই তো সেদিনও কথার নিপাট ভালো মানুষের শরীর জুড়ে ছিল বসন্তের আয়োজন। দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে গজগামিনীর মতো এগিয়ে এসেছিল দখিনা বাতাস। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল কথার যাবতীয় সবুজ রঙ। কিন্তু কোথায় আজ সেই সবুজের সহজতা। জায়গায় জায়গায় সবুজের মনভূমিতে কালচে ছোপ। এ কি আমার সেই চির চেনা সবুজের গন্ধ বাতাস? না, তা তো নয়। পাঁচমাথার ডানদিকে সোজা গিয়ে বাঁক ঘুরতেই দেখি আয়োজন। কথার আয়োজন। মেরুদণ্ড কোথায়? বিশ্বাসের গ্রন্থি ভেঙে ভেঙে সবুজ আজ ধুলোকণা। আকর্ষকে পাথেয় করে সে আজ অবলম্বনের ভরসায়।
কথার ভার কোথায়? কথা তো আজ যেকোনো কথা। সব কথার রঙই আজ এক। দু’পা হাঁটতেই তোমার কথার শরীর আমার কথায় মিশে যায়। কোনো প্রতিবাদ নেই। বিনা আয়োজনেই তারা একে অপরের সফর সঙ্গী। সময় সুযোগ বুঝে কথারা এক এক  জায়গায় ঝাঁক বেঁধে থাকে।
অসহায়ের পাশে কোথায় কথা? কথারা উড়ে গেছে সেই কোন ভোরে। অনেকেই তাদের দেখেছে মাচায়। অনেক অনেক উঁচুতে মাচা। সেখান থেকে তো কিছুই প্রায় দেখা যায় না। দেখতেও কি আছে? আসলে কথারা একদিন দল বেঁধে উঠে গিয়েছিল মাচায়। বোজা ছিল তাদের চোখ। এই শর্তেই তো তারা পেয়েছিল সিঁড়ি। তাই ফিরে আসার পথ তারা জানে না। অবশ্য সে ইচ্ছাও তাদের নেই।
শীতার্ত মানুষের বুক আজ কথার উষ্ণতাহীন। তাই কথা আজ আর আরোগ্য আনে না। কথার মেঘে নেই কোনো বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। কথাহীন ঠাণ্ডা প্রদেশের ফুটপাতের বাসিন্দা আমরা। অথচ চারপাশে কথার ফোয়ারা ছোটে। কিন্তু সেই কথাদের ধরবে কে? সেই কোন কালে তারা তো সব বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের ধরার মতো অত বড় হাত তো আমাদের নেই। যাদুকাঠির অনেক নিচে আমাদের চলাফেরা। আমরা তো পরিবর্তন জানি না। পরিবর্তনের কেনই বা প্রয়োজন সে ব্যাপারেও আমরা বিশেষ জ্ঞাত নই। আমরা তো জানি ধারাবাহিক ভাবে পথ হেঁটে চলা। কোথাও থামা নেই। নেই পিছন ফিরে মূল্যায়নের কোনোরকম প্রস্তুতি। পথ পেরোলেই তো বদলে যায় চারপাশ। তার সাথে আমিও তো বদলে বদলে যাই। তাহলে কেন এই পরিবর্তনের আয়োজন?
আজন্ম যেসব কথার হাত ধরে হয়েছে আমাদের দিনরাত তাদের আজ আর চিনতে পারি না। বুঝতে পারি পরিবর্তনের কথায় আজ আর আমাদের কোনো অধিকার নেই। সহজ কথায় সহজ প্রবেশের সময় আজ অন্তর্হিত।
ফুটপাতের শীতার্ত মানুষ তাকিয়ে দেখে অনেক দূরে মাচা। কথা হয়। কানে আসে শুধুমাত্র কিছু বিমূর্ত শব্দধ্বনি। ওরা কারা কথা বলে? ওদের কথায় কেন চোরা স্রোতের টান? কানের কাছে কে যেন বলে যায় অনুবাদকের নাম। কিন্তু আমি তো তাকে চিনি না। আর তাছাড়া সে আমাকে কেনই বা বলে দেবে ওইসব বিমূর্ত শব্দধ্বনির অর্থ। তারা আরও বলে খাতার কথা। নাম জিজ্ঞাসা করলে আমি সেটাই ঠিক করে বলতে পারি না। আসলে আমার তো কোনো নাম নেই। নাম কে রাখে তাই তো জানি না। কোনো দিন তো খাতা দেখি নি, তাই নামের প্রয়োজন পড়ে নি।
আমাকে কে ডাকবে? আমার তো নামই নেই। ভাষাও তো বুঝি না। খোলা আকাশের নিচে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। পারি না কিন্তু তবুও মনে হয় আমি সোজা হয়েই আছি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি আরও কত কত মানুষ। সকলের চোখেই একটা নিরাসক্তের ছাপ। যেন আর কেউ কিছু পাবে না। নতুন করে আর যেন কিছুই শুরু করা যাবে না। শুধুই দীর্ঘশ্বাস। চোখের সামনে মৃত্যুর ছায়া। আলোর দেশের ঠিকানা সবাই যেন ভুলে গেছে ——- ” দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে / জন্মাতে দেখেছি। “
(গদ্যে ব্যবহৃত কবিতাটি কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা )
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।