• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৫৬)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৯১

আজ ঐতিহ্যমণ্ডিত স্টার থিয়েটারের দোতলায় যখন এই বছরের সেরা সাহিত্যিকের পুরস্কার নিচ্ছি তখন খুব মনে পড়ছিল বাবা মায়ের কথা। বিশেষ করে বাবার। ভীষণ অভাবের মধ্যে ছোটবেলা কেটেছে। কিন্তু তবুও বাবা তার ছেলেকে গতানুগতিক পথে ঠেলে দেয় নি। এই দেশে লেখালিখির পথে পা বাড়ানো মানেই যন্ত্রণাকে সাধ করে নিজের ঘরে নিয়ে আসা —– প্রত্যেক মা বাবাই এটা জানে। আমার বাবা মা-ও এর বাইরে ছিলেন না। কিন্তু তবুও বাবা আমাকে বলেছিলেন, সবাইকে যে চাকরি করতে হবে তার কোনো মানে নেই। তুই লেখালিখিটা মন দিয়ে কর।
গল্প করতে করতে একদিন নবারুণদা (নবারুণ ভট্টাচার্য) আমাকে বলেছিলেন, “আমার বাবা চাইতেন আমি লেখক হই। আমাদের দেশে কোনো বাবার এই চাওয়া সত্যিই বিরল। সেদিক থেকে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান।” কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলে উঠেছিলাম, আরও একজন বাবা চাইতেন তার ছেলে লেখক হোক। নবারুণদা বলেছিলেন, “কে তিনি? একবার প্রণাম করে আসব।” বলেছিলাম, আমার বাবা। কিন্তু ততদিনে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। এখনও ভাবলে আমি এই চাওয়ার কোনো তল খুঁজে পাই না। ভয়ঙ্কর অভাবের মধ্যে “পথের পাঁচালী”-র হরিহরের মতো যজমানিতে যার কোনোরকমে দিন চলত, সেই মানুষটা কোন মেরুদণ্ডের জোরে চাইতে পারত তার ছেলে লেখক হোক।
প্রতিদিন গভীর রাতে গল্প করে ফেরার সময় বাবা সেই দিনের কাগজটা হাতে করে নিয়ে আসতো। আসলে যে দোকানে গল্পের আসর বসতো তারা খবরের কাগজ রাখত। বাবা বিশেষ বিশেষ দিনে কাগজ এনে আমার হাতে দিয়ে বলত, আজ তোদের সাহিত্যের ভালো খবর আছে। বুঝতে পারতাম, কম কথার মানুষটা আমার ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
পড়ার বই বাদ দিয়ে গল্পের বই পড়লে অথবা লিখছি দেখলে মা একটু রেগেই যেত। আসলে চারদেয়ালের মধ্যে মানুষটাকে এত অভাবের মুখোমুখি হতে হয়েছে যে, সে আর সাহস করত না তার ছেলেও একই যন্ত্রণা পাক। মায়ের কোনো চাহিদা ছিল না। আমি কোনোদিন শুনি নি মা বাবার কাছ থেকে কিছু চাইছে। কিন্তু তবুও সে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ চিন্তায় থাকতো।
আমি লিখতেই চেয়েছি। লিখে আমি যে আনন্দ পাই সে আনন্দ আমায় কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না। আমার লেখা যে কেউ পড়বে তা আমি কোনোদিন ভাবি নি। আজ যখন আমার কবিতার পাঠকেরা আমার কবিতা নিয়ে মন্তব্য করে তখন সেটা আমার কাছে একটা বিরাট পাওয়া। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ যারা তাদের হাজার ব্যস্ততার মাঝেও আমার লেখা হাতে তুলে নেন। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যেন লিখে যেতে পারি। জীবনে এ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।