লেখালিখির হাত ধরে অনেকগুলো বছর পার হয়ে এলাম। মনের আনন্দেই একদিন লেখা শুরু করেছিলাম। জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু একদিনের জন্যেও লেখা থেকে দূরে থাকি নি। বরং লেখা ছিল বলেই বারবার জীবনের বৃত্তে ফিরে আসতে পেরেছি। কোনো কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে কলম ধরিনি। মনের আনন্দে লিখি। হাঁটতে হাঁটতে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানেও আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। কবিতার কাছ থেকে আমি কোনোদিন কিছু চাই নি। আজও কিছুই চাই না। লিখে আমি যে আনন্দ পাই সে আনন্দ আমায় কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না।
লেখালিখি যখন শুরু করি তখন তো আমি গ্রামের ছেলে। তেমনভাবে বিশেষ কিছুই জানতাম না। কিন্তু কোনোদিন মনে হয় নি কবিতা দিয়ে আমি কোনোকিছুর বদল ঘটাব। নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও যে আমি খুব একটা উদ্দেশ্য নিয়ে চলেছি তাও কিন্তু নয়। তাই সাহিত্যও আমার কাছে উদ্দেশ্যহীন। পরে যখন বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়লাম তখন বুকের মধ্যে কিছুটা সাহস পেলাম —— “সাহিত্যের উদ্দেশ্য নাই। … সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। ফুল কেন ফোটে তাহা কাহার সাধ্য অনুমান করে। … সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। … যদি কোনো উদ্দেশ্য নাই তবে সাহিত্যে লাভ কি! যাঁহারা সকলের চেয়ে হিসাব ভালো বুঝেন তাঁহারা এইরূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবেন। উত্তর দেওয়া সহজ নহে। গোটাকতক সন্দেশ খাইলে যে রসনার তৃপ্তি ও উদরের পূর্তিসাধন হয় ইহা প্রমাণ করা সহজ, যদি অজ্ঞানবশত কেহ প্রতিবাদ করে তবে তাহার মুখে দুটো সন্দেশ পুরিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার মুখ বন্ধ করা যায় কিন্তু সমুদ্রতীরে থাকিলে যে এক বিশাল আনন্দ অলক্ষ্যে শরীর-মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া স্বাস্থ্যবিধান করে তাহা হাতে হাতে প্রমাণ করা যায় না। … সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীতাতপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফিরে, গন্ধ গান ও রূপের হাট বসিয়া যায়। উদ্দেশ্য না থাকিয়া সাহিত্যে এইরূপ সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয়। “
এইতো সেদিন ১৯৭৭ সালের একটি পত্রিকায় (ধারাপাত) চার্লস ব্যদলেয়ার -এর লেখা থেকে জানতে পারলাম, “কবিতার, যা একজন লেখককে, তিনি যতটুকুনই কবিতার ভেতরে ঢুকুন না কেন, তার আত্মাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তোলে, তার স্মৃতিকে উজ্জীবিত করে, কোনো উদ্দেশ্যই নেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছাড়া, কবিতার আর কোনোই উদ্দেশ্য থাকতে পারে না এবং কোনো কবিতা যদি শুধুমাত্র কবিতা লেখার আনন্দ ছাড়া অন্য কারণে লেখা হয়ে থাকে তবে সে কবিতার মহার্ঘতা, সত্যতা বা স্বকীয়তা সম্পর্কে সন্দিহান হওয়া যায়। … কবিতার উদ্দেশ্য কবিতা নিজেই, সত্য বা তজ্জনিত অনুসন্ধান নয়।”
আজও তাই কবিতা লেখার আনন্দেই কবিতা লিখি। কবিতাকে সামনে রেখে কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছে আমি মনে কোনোদিন ঠাঁই দিই নি। আমি উদ্দেশ্যহীন সাহিত্যের পথ ধরে হেঁটে চলেছি। কোনো মানুষ যদি তার মূল্যবান সময় খরচ করে আমার কবিতা পড়েন তাহলে তা আমার কাছে বিরাট পুরস্কার বলে মনে করি।