সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৫)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৬৭
প্রথম কবে কবিতা লিখি আজ আর মনে নেই। সেদিন আমার মন আমাকে দিয়ে কেন কবিতা লিখিয়ে নিয়েছিল আমি জানি না। সেদিনের আবহাওয়া কী আমার মনের অনুকূল ছিল? এখানেও স্মৃতিপথে আজ আর কিছু ভেসে ওঠে না। তাই এই পথ ধরে হেঁটে গেলে কাউকে চোখে পড়বে বলে আমার মনে হয় না। পথ বদলে অন্য পথের দিকে এগিয়ে গেলে কিছু প্রিয় মুখ, প্রিয় মুহূর্ত স্মৃতিপথে এসে সারি দিয়ে দাঁড়াবে।
মনের কোন অবস্থা আমাকে কবিতার দিকে সরিয়ে দিল? মনের কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হল, কবিতাটাই আমার হবে, কবিতা ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা নেই? ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার জীবন আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হবে না। একটা নির্দিষ্ট জায়গার পর থেকে আমি সকলের থেকে কেমন যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
বৈশাখের দুপুরে সবাই যখন ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকত আমি তখন মা দিদির শাসনের গণ্ডি পার হয়ে বেনেপুকুরের আমগাছের নিচে চুপ করে বসে থাকতাম। সেই সময় আমার দোসর কেউ ছিল না। দূরের কোনো পাখির ডাকে মন যেন কোথায় হারিয়ে যেত। এক একসময় সেই ডাক মনে এতো দুঃখ বয়ে আনতো যে আমাকে সে কাঁদিয়ে তবে ছাড়ত। একটা বছর তেরোর ছেলে আমের জন্য আমতলায় যায়, আমি তখন আমগাছের নিচে বসে চুপচাপ কেঁদে চলেছি। সেই সময় আমার তো কেউ মারা যায় নি। আমাকে কেউ ছেড়েও যায় নি। তাহলে কিসের জন্য এই কান্না? কোন ঘটনা আমাকে ওই বয়সে কাঁদাত?
বিকেলবেলা খেলতে বেরিয়ে যেতাম। যা-ই খেলি না কেন, বাড়ি ফিরতে যেন সন্ধ্যে উত্তীর্ণ না হয়। কড়া শাসন। না মানলে দিদির ভয়ঙ্কর প্রহার। মা সন্ধ্যের শাঁখ বাজাত আর আমি বাড়ি ঢুকতাম। হাত পা ধুয়ে পড়তে বসতাম। মা কলাইয়ের বাটিতে মুড়ি আর ভেলি গুড় দিত। তাই আনন্দ করে খেতাম। মুড়ি খেতে খেতে উঠোনে তাকাতাম। দেখতাম মা তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়েছে। অন্ধকার উঠোনটা ওই প্রদীপের আলোয় এক অদ্ভুত আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। কী দারুণ যে লাগতো সেই সময় তা বলে বোঝাতে পারবো না।
বছরের এক একদিন উঠোন জুড়ে নেমে আসতো গভীর অন্ধকার যখন বাড়ির কেউ মারা যেত। সারাদিন একটা মনখারাপের পরিবেশ। প্রিয়জনকে হারিয়ে আমারও খুব মনখারাপ করত। আমিও খুব কাঁদতাম। দাহ করার জন্য যখন মৃতদেহ তুলে নিয়ে চলে যেত তখন বিকেল ক্ষয়ে ক্ষয়ে চারপাশে সন্ধ্যে নেমে আসত। অশৌচ বলে মা ওইসময় তুলসীতলায় প্রদীপ দিত না। সারা উঠোন জুড়ে তখন গভীর অন্ধকার নেমে আসত। মনে হতো সেই অন্ধকার যেন বুকের ওপর চেপে বসেছে। আমার খুব কষ্ট হতো। এক একসময় সহ্য করতে না পেরে খুব কাঁদতাম। তবে চিৎকার করে নয়। গোপনে চোখের জল মুছতাম। কিছু ভালো লাগত না। ওইসময় নিজেকে খুব একা মনে হতো। ওইসময় কারও সাথে মিশতে পারতাম না। কথা বলতেই ভালো লাগত না। মনে হতো আমাদের সারা বাড়িটা এমন এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ডুবে আছে যেখান থেকে আমাদের কোনো নিস্তার নেই। অন্ধকারেই আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।  একরকমের ভয় মনের মধ্যে কাজ করত। মনে হতো আমি বোধহয় হারিয়ে যাব। চোখের সামনে কাউকে দেখতে পেতাম না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।