সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৮৫)

সোনা ধানের সিঁড়ি
১২২
তখন সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি কি দিই নি। ওই ভয়ঙ্কর দৌড়ঝাঁপের বয়সেও আমি কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতাম ফাল্গুন মাস থেকে। তখন গ্রামে ঘরে আজকের মতো এতো তাড়াতাড়ি গরম পড়ে যেত না। চৈত্র মাসের শুরুর সকালগুলো গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়াতে হতো। কিন্তু তাহলেও দুপুরের রোদটা বেশ চড়া হয়ে উঠতো। আর ঠিক এখান থেকেই আমার আনমনা হয়ে যাওয়া। আনন্দের শুরু।
না, বসন্তকাল বলে আনন্দ হতো না। আমি ফাল্গুনের একেবারে শুরু থেকেই গ্রীষ্মের পদশব্দ শুনতে পেতাম। তখনও শীতের কামড় বেশ থাকত। কিন্তু দুপুরের রোদ এলেই চারপাশটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করত। যদিও খুব বেশিক্ষণ এই রোদটা থাকতো না। কিন্তু তবুও ওইটুকুই আমার কাছে অনেক। কারণ যে দুপুরের জন্যে আমার পথ চেয়ে বসে থাকা, শীতকাল তার কোনো অস্তিত্বই তো থাকত না। এই প্রথম আমার দুপুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর তাই এতো আনন্দ।
খাঁ খাঁ দুপুরের শুরু মানেই মায়ের সঙ্গে আমার লুকোচুরি খেলারও শুরু। দুপুরবেলাগুলো মায়ের কাছেই শুতাম। কিন্তু যখনই মনে হতো মা ঘুমিয়ে গেছে তখনই আমি পা টিপে টিপে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে পালাতাম। কতবার যেতে গিয়ে ধরা পরে গেছি। তখন মা আবার দিদিকে ডেকে জোর করে শুইয়ে রাখতো। সে এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। আমার দশ বছর বয়স থেকেই এই মায়ের সঙ্গে আমার এই লুকোচুরি খেলার শুরু।
যেদিন মায়ের চোখে ফাঁকি দিতে পারতাম সেদিন একেবারে সোজা বেনেপুকুরের পাড়ে। কেউ কোথাও নেই। আমি একা আমগাছের নীচে চুপচাপ বসে থাকতাম। আমের মুকুলের গন্ধ আর সামনে ওই খাঁ খাঁ দুপুর। সে যে আমার কাছে কতখানি আনন্দের ছিল তা ঠিক বলে বোঝানোর নয়। বেনেপুকুরের পাশেই ছিল শ্মশান। কোনো কোনো দিন আমার কোনো মৃত স্বজনের জন্যে খুব কষ্ট হতো। এমন কত দিন গেছে তাদের জন্যে আমি কেঁদেছি।
আজও আমি বসন্তের শুরুতেই গ্রীষ্মের পদশব্দ শুনতে পাই। আজকের জীবনে তো আমার কোনো আমবাগান নেই তাই দুপুরের রোদ একটু চড়া হলেই আমি গ্রামের কোনো রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। হ্যাঁ, দুপুর দেখি। ঘন্টার পর ঘন্টা। এই দেখা আমার কোনোদিনও ফুরোবে না। আজও আমি দুপুরের রহস্যকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। দুপুরের কাছে বসে আমি আমাকে খুঁজে পাই। তাই প্রতিটা দুপুর আমার কাছে উৎসব।