T3 || সৌরভ সন্ধ্যায় || লিখেছেন জি কে নাথ

ঘুমের ভিতর ঈশ্বরের বাগানে

এভাবেও কি চলে যাওয়া যায় ! হয়তো যাওয়া যায় না। কিছু না মেলা প্রশ্নের ভিতর পুঁতে দিয়ে যায় ভবিষ্য সম্ভাবনার কোনো নিবিড় প্রশ্ন।
“মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/ তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু অমৃত করে দান”
ক্রমে ধীরে ধীরে ভিজে ওঠে অথৈ দুঃস্বপ্নের দালান অবচেতনের নীলাভ জোছনায়। মাটির গভীরে রুপোলি বনের ছায়ায় ভেসে গেছে পাঁজরের ছিন্ন অস্থি। ফুরানো জীবনের আয়ুর ঘরে জলের কুঠুরিগুলো খুলে গেছে শান্ত ঘাসের দিকে ঢালু নেমে । পাহাড়ি অরণ্যের হারিয়ে যাওয়া পাখিরা ডেকে ওঠে অদ্ভুত এক বিকেলে । রোদের শেষ ছায়াটুকু শুষে নিচ্ছে অস্থিরতার কাঁপা ঠোঁট। আঁশটে জলের ছায়ায় কেঁপে ওঠে হৃদবনের নির্জনতায় ঝরাপাতা চোরামনের শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে । শব্দহীন একাকী পিঁপড়ের মুখে পেরিয়ে মিশে যাওয়া দিনের আলোয় ভেসে ওঠে মায়ার শিকড় । ভেসে আসে দূর হতে তারার গায়ে লেগে থাকা শরীরের মাটিসবুজ চিরশান্তির অদ্ভুত এক গন্ধ।
“তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।
তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয়॥
মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে,
আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়–
বায়ুপরশন নাহি সয়॥
এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,
দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।
মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে,
সব আবরণ হোক লয়–
ঘুচুক সকল পরাজয়॥”
গভীর ঘুম ভেঙে আশ্চর্য সকালের চাঙর পড়ে আছে যন্ত্রনায় খুঁড়তে খুঁড়তে বুকের অদৃশ্য গোপন বিষাদের গহনে।
‘আমাদের সকলকে নিমগ্ন থাকতে হবে স্বপ্নের কাছে যা আগামীর সোপান হবে’ কথাটা শেষ হতেই নীল ছবির আকাশে শার্টের নীল সাদা ছোপ গুলো কেমন যেন মেঘ হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে । কপালের আশীর্বাদী টিকা গলতে গলতে সূর্যের মতো রক্তিম হয়ে উঠেছে। সহজ মোহনচূড়ার জলে ভিজে ওঠে খরচ হয়ে যাওয়া স্বপ্নের সোনালী মৃত দলিল । শীর্ণ বোধ সাঁতরে উঠে আসা শিশুমেঘ ছিঁড়ে সেতার কাঠে বিযুক্ত হয়ে পড়ে দূরস্থ নিশ্চল রক্তজালিকার ছায়ায় ঘুমবাহিত অনিদেশ্য পথের জড়ানো মৌসুমী স্বরলিপি। জীবনের যা কিছু শেষ এই ম ম গন্ধের ভিতর রজনীগন্ধার হ্রদে উড়ো চুলে বাঁধা ভোরের ঝাপসা কাগজ কুড়তে কুড়তে বিস্ময় বুকে সংসারহারা অশেষ বালক দেখি দাঁড়িয়ে আছে মুক্ত হাতে । পরিযায়ী কথার ভেলায় সম্মোহিত দু’চোখের উপমা চিতাচোর মৃদু সঞ্চারী খেলার সন্তাপে ভেঙে খুলে যায় , গড়িয়ে ভেসে যায় অযুত অতীতের আঘাত । গিলে খায় ক্ষয়ের বাজ পড়া মাটির অন্ধকারে ত্রিকোণ শ্বাসের সারি সারি বিনাশের স্নায়ুরেখা। অবিশ্রান্ত শ্রাবণ ভেজা পথের ফিকে জোছনায় ভস্মীভূত আস্বাদহীন কৃষ্ণ আঁধার জিভে ভাঙ্গন ধরে ক্রমে । সামুদ্রিক নোনা গরাদ ছেড়ে চলে গেছে অসমাপ্ত কাজ সমস্ত শরীর জুড়ে। স্থির তাকানো দূরে বৃষ্টির পিঠ বেয়ে মেঘের দেওয়াল লেখে জীবন ছিন্ন বসন্তের পরমায়ু । চিহ্ন ফেলে মাটির ছাপে দুলে ওঠে উপহারের ফুলে শুকিয়ে ওঠা বাগানের হাওয়ার মাঝ বরাবর মৃত্যু ডিঙানো উদাসীন মরুপ্রান্তর।
“আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে–
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে চলে গেল, বলে গেল না– সে কোথায় গেল ফিরে এল না।”
বাতাসের থোকায় থোকায় জ্বলে ওঠে জোনাকিসৌরভের সৃষ্ট হাজার হাজার তরুণলন্ঠন । জানি এ পথেই শেষ হবে পথের সমস্ত ফুরানো কথা। ওহে, পথিক দেখ পথ হারিয়েই লিখে রেখেছ কেমন সমস্ত দিকের সন্ধ্যার মতো মৃত্যুর নামাবলী। সবুজ কেবল একটাই হাড়ে ভেসে আসে কালের ধূসর ধোঁয়ায় ভাসা চিরচেনা এক মুখ। অনেকটা দূরত্ব বেড়ে ওঠা পথের উদাসী রোদের রেণু উড়ে ভেসেছে সবুজনীল সমুদ্রের ভালোবাসায় । অক্ষরহীন সাদা কাগজ নৌকার ছাদে বর্ষার মুখে ঝিলমিল পূর্ণিমার প্রদীপ রেখে বেশ কিছুসময় কথা বন্ধক রেখেছি । দেখি আঁকড়া ফেরত মেঘলা দোপাটির চারায় মুখ ঢেকেছে শান্ত ভোরের গঙ্গার ঘাট। শিথিল আয়ুর পরিজনেরা বিস্তারিত হলে অনিকেত প্রহরের দুয়ার খুলে প্রাণ থেকে ঘুড়ি ছেড়ে অনন্ত।
“একদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যেও সে যেন শুনতে পেলে সমুদ্রগর্জনের মতো শব্দ। দলে দলে দেশবিদেশের লোক চলেছে–কেউ বা রথে, কেউ বা পায়ে হেঁটে; কেউ বা বোঝা পিঠে নিয়ে, কেউ বা বোঝা ফেলে দিয়ে।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উৎসবের ঋজু আঙ্গুর ক্ষেতে স্বপ্নঘুম ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে সময় ধারায় মিশে গেছে বহমান নদীর মতো মেঘ, বৃষ্টি হাসি কান্না আলো ছায়ার স্বপ্নময় দিনগুলো রাখাল বাঁশির অন্তহীন সংগোপনে বুকের মাটিতে শিকড়জলে। গাছের বোবা ভাষায় ভাষায় শিশির জলে ডুবে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর কান্না। নিঃশেষ হাওয়ায় জলে ভিজে ওঠে বোবা নদীর সাথে সবুজ ঘাসের অসফল ডাংগুলি খেলা । কড়া নাড়া মৃত্যুর দরজায় চিরহরিৎ আয়ু হারিয়ে গেছে জনঅন্ধকারের মিছিলস্রোতে । এখন কোনো প্রেম নেই , কোনো ভালোবাসা নেই–কেবল শূন্যতায় নীল বরফ অন্তহীন ডুবে যাচ্ছে ছাই ওড়া আকাশে আজন্মের মৃত্যুর শীতলতা জীবনের প্রারম্ভে । খসে পড়ে ঋতুহীন আগাছার নিভৃতে ব্যক্তিগত জীবন থেকে ভেতর বৃত্তে সীমিত ধূপের বিষাদে শুয়ে থাকা হাহাকার , যেন শূন্যতায় মোড়া অপরিপূর্ণতা।এখন সমস্ত অস্তিত্ব এর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখছি ঈশ্বরকে। কুয়াশায় ফুটে ওঠে ঈশ্বরের জ্বলন্ত দু’চোখ । ক্রমশ পিছলে সরে যাচ্ছি আমরা।
ঈশ্বরের চোখে আজ জল।
একান্ত নিশ্চুপ চলে গেছ এক সময়কথা শুরুর দিন কুঁড়ির কৃষ্ণগর্ভে ফুলের মনজোড়া ভাষামঞ্জরীর অচিন পর্যায়ে । জন্মের চৌকাঠে ঘুম লেগে থাকা বুক জুড়ে কেবল শব্দের ক্ষীণ বাষ্পের বুদ্বুদ ওড়ে। ওড়ার ছায়ায় ছায়ায় সুরভিত মায়াবী অসুখের দিন । কালো শোকের ছায়ায় নেমে গেছে সিঁড়ি । কেবল ফিরে দেখছি বারবার জীবন শেষের এক সুনিপুণ তামাশা । এমন ফাঁদ পাতা বৃষ্টির বিকেলকুহরে উড়ে যায় প্রবাহঅস্থির আয়নার বাইরে প্রতিবিম্বিত মজা আলোর অভিমানে স্বপ্নকুসুমের একক আলোর রঙিন প্রজাপতি। অসহায়তায় ঘনিয়ে ওঠা সম্পর্কের সৎকার সেরে ধীরে ধীরে ক্লান্ত ঘোলাটে আধফোটা গানের সমস্ত অবারিত ঋণের কাছে নির্বাক হয়ে দেখতে থাকি আত্মদহনের অবাধ অন্ধকারে নিমজ্জিত ফাঁকা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একমুঠো খই , স্বাধীন পাখির মতো । উড়ে যায় কেবল উড়ে যায় অবেলার লেগে থাকা ছায়ায়। এসো এইবার, সন্ধানী উদ্বৃত্ত অক্ষরের পাশে বসি । আশ্চর্য শীত এসে বুলিয়ে যাবে তোমায় লেখা চিঠির অসমাপ্ত ভাঁজে রাখা না বলতে পারা অক্ষরগুলোর জন্মদিনের মৃত্যুদিন !
সমাহিত চিরশান্তির ভিতর সুরভিত সৌরভের নির্যাসটুকু পোড়ে নিজস্বতায় সবটুকু স্মৃতি নিয়ে একটু একটু করে…..
এই প্রথম আমি আজ ঈশ্বরকে পরাজিত হতে দেখলাম।
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।