কথা সাগরে মৎসাপুরুষ গোবিন্দ ব্যানার্জী (ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী)

রূপকথার গাঁয়ে পাঁচদিন

অনেকটা দূরে পাহাড়ের চূড়া থেকে সারা গা জুড়ে বসতি দেখি দার্জিলিং শহরের। একসময়ের মুগ্ধ শৈলশহর ধীরে ধীরে বস্তি হয়ে উঠেছে। চারিদিকে হোটেল, বাড়ি… ওখানে যতবার গেছি পাহাড়ের ছোঁয়া পাইনি। ঘিনঘিনে বসবাস আর বিরক্তিকর চীৎকার… এদিকে শুরু হয়ে গেছে জ্যাম। বুঝতে পারি কার্সিয়াং। গাড়ি চলা পথের ডানদিকে টয় ট্রেনের দু’সারি একালসেড়ে পথ। একটু উঁচুতে উঠে গেছে আত্মসম্ভ্রম রক্ষা করতে।সেই পথের পাশে ঘেঁসাঘেঁসি ক’রে গৃহস্থের বাড়ির সিঁড়ি। সবজি এবং মনোহারী দোকানের পসরা। পোশাক মেলে দেয়া দড়ি টাঙিয়ে। ম্যাটাডোর, মোটরগাড়ি, টু হুইলার দিব্বি উঠে বসেছে তার উপর। সোমনাথ হেসে
উঠল… কী অবস্থা দেখুন মাসাই। রেল লাইনেও দোকান ব’সে গেছে। ট্রেনের অবস্থা তো শোচনীয়, এই সব সরানো হবে, তারপর হেলতে দুলতে তিনি যাবেন। রাস্তা জুড়ে স্থানীয় মানুষের আলস্যযাপন।দোকানে দোকানে শীত পোশাক ঝুলছে, খানিকটা রাস্তাতেও চ’লে এসেছে তার ওম। মনে পড়ছে অন্য ছবি। রিমা… কোঁকড়ানো চুল, চোখের ভিতর সরু তীক্ষ্ণ চাহনি আর রঙিন পোশাক… ব’সে ছিলাম মোমো ভরা প্লেটের সামনে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল দোকানে। তারপর ভাব হতে দেরী হয়নি… সেই প্রথম সান্দাফুর ট্রেক ছিল আমার। আমার সারাটা ট্রেক পথের চঞ্চলতা ছিল রিমাকে নিয়ে। এরপর খুব বেশী সময় লাগলো না ঘুম স্টেশনে পৌঁছুতে। একটা হারিয়ে যাওয়া ছবির জন্যে দীর্ঘনিঃশ্বাস আর কতটুকুই বা।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেল স্টেশনের গর্ব ছিল এই ঘুম। এখন তাকে ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে চীনদেশের রেল সফর। সময়টা শীতকাল। এখানে এখন চলছে ঘুম উৎসব। স্টেশনের আশপাশ জুড়ে বসেছে নানা রঙের দোকান। এবং খাবার দোকানই বেশী। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সংরক্ষিত পুরোনো ইঞ্জিন। দাঁড়িয়ে আছে বেশ নব সাজে সজ্জিত টয় ট্রেন… সোমনাথ ছবি তুলছে শিশুর আনন্দে। ওর প্রথম দেখা ঘুম উচ্ছল হ’য়ে উঠেছে। ওদিকে বাঁধা স্টেজে গান গাইছেন স্থানীয় কোন বিখ্যাত শিল্পী। সামনের পেতে রাখা চেয়ারে ব’সে আছেন জনাকয় মাত্র। সম্ভবতঃ তারা শ্রোতাও নন। একটু রোদ্দুরে ব’সে আছেন উত্তাপ নিতে। একে অপরের সাথে ঘরের গল্প করছেন গাঢ় ঘনিষ্টতায়। ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন আমরা পর্যটক… এক দোকানী মহিলা মোমো খেতে আহ্বান জানাচ্ছেন। অথচ এত এ ত কিছুর মধ্যেও বড় কাতর মনে হয়। মন রে… “কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারি ঘোরে…” এত স্মৃতি ভীড় ক’রে আসে যে কেন এই শেষ প্রান্তের পথটুকুতে…

কুড়িটা বছর হুস ক’রে পিছনে টেনে নিয়ে যায় সে। ওপাশে বেঞ্চে ব’সে আছে রিমা। পিছন ফিরে। তার মুখের আভাসটুকু দেখি। শরীরের অদ্ভুত ভঙ্গী আর পাহাড়ের উল্লাস মাখামাখি হয়ে আছে ওর ব’সে থাকার ইশারায়। সোমনাথ মোমোর প্লেট ধরিয়ে দিল হাতে। সে যে কী অপরূপ আস্বাদন…

চালশার অনিমেষের সাথে তবু দেখা হওয়াটা কিন্তু জরুরী ছিল। ডুয়ার্সের আদ্যপ্রান্ত ওর হাতের তালু। আর আমরা চলেছি পূর্বকথনের একগাদা অপেক্ষা গুছিয়ে নিয়ে। চোখের মণিতে এঁকে নিয়েছিলাম সামসিং, সুন্তালেখোলা আর রকি আইল্যান্ড। সেও হয়ে গেল বছর আঠেরো। ঐ পথে পদচারণার গল্প আর বিস্ময়গুলো উপচে উঠতে চাইছিল হতাশ সময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম, আরেকবার জলে হাত ছুঁয়ে আসবো সুন্তালেখোলায়। সারা শরীরে নরম শীতল নদীস্রোতের কথা মিশিয়ে নেবো মূর্তির ছলছলে সুরে। চা বাগানের টং ঘরে কাটিয়ে আসবো দু’রাতের রোমাঞ্চিত অতিযাপন। হ’ল না। সফরের প্রথম চলাচলেই মোবাইল বেজে উঠল… ওর সাথে দেখা হ’ল না। চলে যেতে হয়েছে অসুস্থ নিকটজনের কাছে…কোচবিহার। সাঙ্গ হ’ল ধূলোখেলা।

অথবা প্রশান্ত। তাকেও পেলামনা সফরের সূচনায়। শেষপর্যন্ত প্রথম পরিকল্পনা আঁকা কাগজখানা মুড়ে ব্যাগের কানাচে রেখে দিলাম। ‘বাতিল’ শব্দটা লিখে দিলাম লাল কালিতে। অতঃপর এই পথে। ঘুম স্টেশনে এসে খানিকটা বিরতি। পুরোনো রেল ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ ভোঁ শুনছি, আর সোমনাথ ছবি তুলছে। চারিদিকে সজ্জিত টবে ফুলেল সম্ভাষণ। তাদের রং বাহারী সৌন্দর্যের সাথে মিশে যাচ্ছে আমাদের মন কেমন করা তীব্র ভালোলাগা। উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আছে অজস্র বাড়ি। দ্বিপ্রহরের আটপৌড়ে একটা উদাসীনতা লেগে আছে তাদের গায়ে। হেলেদুলে খসখস ক’রে চলেছে বিলম্বিত জীবনের ছায়া।

আমাদের যেতে হবে… দূর পাহাড়ের অজানা পথ ঝিলকিয়ে উঠছে বুকের আড়ালে। তাড়া লাগালাম সোমনাথকে। ন্যাপস্যাক তুলে নিলাম পিঠে। ও তখনও হুমড়ি খেয়ে মোবাইল ক্যামেরা ধ’রে আছে চমকে দেখা ক্যাকটাসের হলুদ ফুলের কাছে। তাও যেতেই হবে। পাশেই সুখিয়াপোখরির পথে শেয়ার জিপ দাঁড়িয়ে আছে… ড্রাইভার বুঝে গেছে ঠিক, আমরা ওর গাড়িতেই উঠবো। বেশ। উঠে পড়লাম, সব সিট ভ’রে গেল… অতঃপর চললাম সুখিয়া।

যে সময়গুলোকে, অথবা তোরঙ্গের অন্ধকারে যে দিনগুলো, সত্যতাগুলো, উদযাপনগুলোকে ঢেকে রেখে এসেছি আপদমস্তক… আমার পালিত সেই অতীতের পুঁটুলি যতই কেন ঘুমিয়ে পড়ুক, পথের চলাচলে এসে হঠাৎ জেগে ওঠে। অচৈতন্য ব্যথার মোড়ক খুলে চেয়ে থাকে সমান্তরাল দৃষ্টিকোণে। এই যে পিছনের সিট থেকে কম বয়েসী এক মেয়ের কন্ঠস্বর কানে এসে বাজল… আপ কাঁহা যাইয়েগা? সোমনাথ কানের পুঁচকে শব্দযন্ত্র খুলে পিছন ফিরে তাকালো, আমার কানের কাছে ওর নিঃশ্বাসের ওম এই যে একটা দৃশ্য… যেন দৃশ্যের অনির্বচনীয় এক পরম্পরা। রিমার ঠোঁটের ভিতর থেকে নরম গন্ধ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার কাঁধ। আমি চোখ বুজলাম। জ্যাকেটের ভাঁজগুলো জেগে উঠছে সেই আলতো গন্ধের স্পর্শে। কুড়িটা বছর বেমালুম উহ্য হয়ে যাচ্ছে সময়ের দোলনা থেকে। হাতের ভিতর রিমার গল্পগুলো, আঙুল জড়িয়ে আছে। অস্ফূট কথা শুনি শুধু সোমনাথের কন্ঠস্বরে… ধোত্রে তক্। একটু বিরতি। আর সেই ফাঁকে রিমার চোখে ছবি ভাসছে লেপচা গ্রামের। কবে, কোথায় যেন… মনে হয় স্বপ্নের ভিতরে শুনেছি ওই গ্রামটার কথা। মাত্র তো আট কিলোমিটারের দূরত্ব… মনে হয়, ওখানে নেমে পড়ি। পাহাড়ী ঘরগুলোর ছায়ায় গিয়ে বসি একটু। সেই ছায়ার গভীরে পুরোনো গাছগুলোর গুঁড়ি… ছুঁয়ে দিয়েছিল আমাদের সেই সময়টাকে। আর দূরে একটা ভেসে আসা সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার আগে শৃঙ্গের উপর আবেশে এলিয়ে পড়েছিল একটা মানুষের শরীর। সবাই ঐ অনন্ত তুষারে শুয়ে থাকা মানুষের অণুরূপকে একটা নাম দিয়ে তৃপ্তি পেয়েছে। অথচ রিমার কাছে ছায়াময় হয়ে শুনেছিলাম… ঘুমিয়ে থাকো সময়। তোমার কাছে বারবার ফিরে এসে শুনে যাবো আমাদের খে যাওয়া সময়ের গল্প। তারপর আবার আবার আসবো। বসবো নতজানু হয়ে…উন্মুখ। অথচ কেউ কথা রাখেনি রিমা। তুমিও না। সময়ের কাছে একা ফেলনার মত পড়ে আছে আমার নির্বোধ স্মৃতি।

সেদিনের ছোট্ট লেপচা গ্রামখানা এখন হয়ে উঠেছে লেপচা জগৎ। কত ক ত ঘর গড়ে উঠেছে। পিছনে ব’সে সেই পাহাড়ী মেয়েটি বলছে… সুখিয়াসে তো শেয়ার গাড়ি হ্যায়, মিল যায়েগা তো আচ্ছাই হোগা, লেকিন এক দো গাড়ি হ্যায়, উধার মানেভঞ্জনমে বড়া ল্যান্ড স্লাইড হুয়া। ইসি লিয়ে রোড আলাগ হো গয়ে… গাড়ি ভি কম। পেরিয়ে যাচ্ছি লেপচা জগৎ। সোমনাথ চোখের মধ্যে আশঙ্কা আর প্রশ্ন গুছিয়ে নিচ্ছে। দুপুর পেরিয়ে ফেলেছি ইতিমধ্যেই। ডান দিকে উপরে দূরে নীল আকাশটা পাহাড়ী গড়ান থেকে উঠে আসা গাছেদের মাথার ফাঁকে ফাঁকে তীব্র ইশারায় ডেকে চলেছে…যখন সেই প্রেক্ষাপটে জেগে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপোলী চূড়া। সেই দিকে চোখ রেখে আশ্বস্ত হ’তে চাইলাম… সুখিয়া পর্যন্ত চলো তো, পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে গিয়ে এই দুই পথ পাগলকে আশ্রয় দেবে… সে সব বিকেলের আবছা আলোর কাছে গচ্ছিত রাখো। এখন ঐ দিকে চেয়ে দেখো… সময়ের এই অবিকৃত অবসরটুকু আয়েশে উপভোগ করো… ঐ খানে, ঐ তুষার সাদা শৃঙ্গের চূড়ায় চূড়ায় পরম আবেশে নিদ্রিত আছেন.. মানব সন্তান গৌতম বুদ্ধ। অন্ততঃ তাই মনে করি আমরা। এখন কোন উদ্বেগ নয়। শান্তি…

আমাদের নিয়ে জাগলিং খেলতে খেলতে অসহনীয় ধ্বজা রাস্তায় ছুটে চলেছে শেয়ার জিপ। তুষারদৃশ্য থরথর ক’রে কাঁপছে। সোমনাথের মাথা গাড়ির ছাদে গিয়ে দমাস… ঠিক এই সময় পিছনের মহিলা বলছে… “প্যাহলে আপ ডিসাইড কর লো, কাঁহা যাইয়েগা।” সোমনাথ মাথায় হাত চেপে যন্ত্রণার ফাঁকে হাসি গুঁজে বলল… “অবতক্ উপর যাউঙ্গা, প্যাহলে তো সুখিয়া যানে দো।” আমি ঝাঁকানির মধ্যে যতটা শব্দ স্থির রেখে বলা যায়… “তুম কাঁহা পর রহেনেবালা হ্যায়? রহেনা কা ঘর মিল যায়েগা তো তুমহারা পাশ হি চল যাউঙ্গা।” নেহাত মজাকি। অপঠিত চিত্রনাট্যে কি যে লেখা আছে না জেনেই। মহিলার কন্ঠস্বর…”এক ঘর হ্যায় রহেনে কে লিয়ে। মানেভঞ্জন সে থোরাসা, পাঁচ কিলোমিটার দূরী হ্যায় মেরী গাঁও। আচ্ছা ভি হ্যায়। বহোত খুশ ভি আ যায়েগা আপ।” সোমনাথের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর চোখ চকচক করছে অনির্দিষ্টের ভিতর ডুবতে ডুবতে। ও বলছে…”চলুন মাশাই। কি আছে, ক’দিন তো হারিয়ে যেতেই এসেছি।” ওর চোখের মণিতে দেখছি নাদেখা একটা পাহাড়ী গাঁও।

সুখিয়া বেশ বড় জনপদ এখন। বিশ বছর আগের গ্রাম্য রূপ পাল্টে গিয়ে এখন সে নগর নটী। দোকান আর দোকান। নানা দিকে যাওয়ার অজস্র গাড়ি। মানুষের ছটফটে ভিড়। এবং এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের অন্বেষণে একটা চায়ের দোকান। আগে সেটাই দরকার। ছোটোখাটো চেহারার সেই মহিলা বেশ কম বয়সী ও সুন্দরী। আমাদের আগলে নিয়ে থাকতে চাইছে। বললাম..” চা পি কে যাউঙ্গা, থোরা রুকিয়ে।” পাশেই দোকান, বাইরে দাঁড়িয়ে চায়ের জন্যে হাত বাড়ালাম।

না, ধোত্রের শেয়ার গাড়ি পাওয়া গেল না। খবরটা এনে দিয়ে মহিলাটি আমাদের দিকে চেয়ে রইল। এবার সঠিক বাস্তবতায় দাঁড়ালাম। অর্থাৎ আজ আমাদের ধোত্রে যাওয়া বাতিল হয়ে গেল। এবং চা টুকু শেষ ক’রেই উঠে পড়তে হবে মানেভঞ্জনের জিপে। যা আমাদের নির্ধারিত পরিকল্পনার বাইরে ছিল এতক্ষণ। পিঠের রুকস্যাকটা একবার হাল্কা ঝাঁকিয়ে নিয়ে সোমনাথ বলল…”চলুন তো যাই… তারপর দেখা যাবে।”
…….. ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *