|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় গৌতম বাড়ই

লালমোহন

খইলটিরে কোনঠি চইললি?
আফসানা বিবি নাদিম শেখের কথার উত্তর দেয় না।
ফুলবাড়ি গঞ্জ এখন কালে কালে শহরের চেহারা নিয়েছে।ঢাওস ঢাওস বিল্ডিং বাড়ি।হাটতলা আছে কিন্তু সেই প্রকান্ড ঝুড়ি বের করা বটগাছটি নেই।উন্নয়নের জোয়ারে ওরকম দুচারটি বট পাঁকুড় জাম কাঁঠাল আম শিশুর মুন্ড ছেদন চলেই।এশিয়ান হাইওয়ে হয়েছে।নেপাল থেকে বাংলাদেশ।ফোর-লেন জাতীয় সড়ক।একপাশে ঘোষপুকুর বাইপাস।বড় বড় সড়কজালে জড়িয়ে ফুলবাড়ি এখন জমজমাট।প্রাইভেট বহুতল হাসপাতাল বড় বড় স্কুল হোটেল।অদূরে মিনি মহাকরণ।বড় বড় বাহারী বাড়ি অথচ তাদের অবস্থা সেই তিমিরে। শিলিগুড়ি শহরটা তাদের গ্রাস করে মহানগরী হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাদের জীবন সংগ্রামের একদম বদল হয়নি।মূল সমস্যা যা ছিলো তাই।খইলটি প্রথমটায় ভেবেছিলো যাবেনা।আজ ঐ যে বছর বছর শুনে আসছে স্বাধীনতা দিবস।ঠিকাদার কাল রাতে খবর দিয়েছে আজ একটা ছাদ ঢালাই আছে।খইলটি তাই বেরিয়েই পড়ে।ঘরে বসে থাকলে চলবে না।দুটো পয়সা কামাই বন্ধ হবে।
খইলটি ঘর থেকে বের হয়ে দূরের কাঁটাতার দেখে।পুরোনো মানুষজন সব যারা তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে কত কথা শুনেছিলো–আমরা নাকি পরাধীন ছিলাম।সাহেবরা আমাদের মেরে মেরে শাসন করতো এই দেশ।ঐ যে বাংলাদেশ ওটাও আমাদের দেশ ছিলো।
নাদিম শেখ আজ ঠিক করেই নিয়েছে কাম কাজে যাবে না।বিবি যাচ্ছে যাক গা।ছেলেপুলে যা খুশি করুক।ও গ্রাম থেকে নড়বে না।বীরবলের বাড়িতে মজা মারবে।জৈতু আর শিবেন ও আসবে।
নাদিম বসে বসে ভাবছে গভীর চিন্তায়।শিবেন সেভেনটির বোতল ধরেই চুমুক মারছে।
জৈতু বীরবলের দাওয়া থেকেই জোরসে চীৎকার করে ওঠে—এ শালা হারামী নাদিম তোর বিবি খইলটি আমায় কিন্তু শাসায় গ্যাছে দারু বেশি টানবি না।শালা ঘোৎরাচ্ছিস বসে বসে?খইলটি বিবির চেল্লাইনি মুই বহুত ডরাই।এ শালা!
–তুই ডরায় ক্যান?বিবিডা ক্যার?ও সব ছেড়ে দেশটারে নিয়ে ভাব। সাধীনোতা কি জানিস?
ওদের মধ্যে বীরবল একটু পড়াশোনা জানে।দু’বছর হলো ওর বৌ মারা গিয়েছে।রাতগভীরে যেদিন অসুস্থতা অনেক বাড়লো ওর বৌ শিপ্রার ফুলবাড়ির প্রাইভেট হাসপাতাল ভর্তি নিলোনা।ঐ রাতে যেতে হলো শিলিগুড়ি শহরে বারো কিলোমিটার দূরে।বৌটা সকাল হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলো।তারপর থেকে ছেলেমেয়েগুলো ওর শ্বশুর বাড়িতে হপতিয়াগছে।একলা থাকতে থাকতে নিজেই মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধব ডেকে সে জ্বালা মেটায়।
বীরবল বলে–স্বাধীনতা মানে আসলে কী?তোরা গান্ডু! ঐ নেতাদের কথা শুনিস আর ভাবিস আমাদের দেশ মহান দেশ। শুধু শাসনভার পাল্টায়।দেশীলোকগুলান ঐ সাহেবগুলানের জায়গায় বসিয়া আমাদের এই সত্তরবছর ধরে একই রাখিয়াছেন।মাঝখান থেকে আমাদের বাপ দাদুর চোদ্দপুরুষের ভিটামাটি সব বেইচ্যা মুই দিনমজুর হলাম।
ঠিক কইছিস বীরু।জৈতু বলে।
শিবেন বলে–আমাদের এলায় দেওয়ানীর কোথা মইনে পড়ে।দেওয়ানী কত্তো কোথা বইলতো–হামাগো সাধীনোতা ফিক্কা দেওয়া সিক্কা।ভিখ।দেওয়ানী বইলতো আরও,নেতাজী আর ভগৎ সিং থাকলে হামাগো মানচিত্র বদলাইতো না।মুই তো আজিও পরাধীন থাকি গেলাম।তোমরাও থাকবান।দেইখতে পাচ্ছি।
চারটে মাতাল বীরবলের প্রশস্ত আঙিনায় স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছিলো।কেউ কাম ধান্দায় যায়নি।বীরবল বাড়ির কোনে দাঁড়িয়ে মাতাল চীৎকারে বললো,একটু মুতে নি মন খুলে।এমন সময় দূর থেকে কলরোল ভেসে এলো অনেকে দৌড়ে এদিকে আসছে।নাদিম নাদিম খইলটি খইলটি চীৎকার পাড়ছে।নাদিম টলতে টলতে পড়ন্ত বেলায় সেই দিকে তাকায়।
–আরে নাদিম এত্তিকানী ফুলবাড়ি হাটত মোড়ে এক্সিডেন্ট হইছে।তোর ছেলৎ। জহিরুল এর।একজন চেঁচিয়ে বললো ভিড়ে।
জহিরুল,নাদিম বাড়ি থেকে বেড়োনোর সময় আবদার করেছিলো লালমোহন খাবার।অনেক নাছোড়।নাদিম কুড়িটাকা দিয়ে আসে।
নাদিম টলমল পায়ে জ্ঞান হারাবার আগে ফুলবাড়ির বড়বড় লালমোহনের গোল্লা দেখছিলো চোখে। জহিরুল খুউব খেতে চেয়েছিল স্বাধীনতা দিবসে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।