এক টানা বৃষ্টিতে প্রায় বুক অব্দি জল। বিপর্যস্ত জনজীবন। পেটে ভাত নেই, ভেসে গেছে মাথার ছাউনি। অথচ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা নেই। এদিকে মাথার ওপর ঝুলছে প্রতি সপ্তাহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে উপর মহলের নানান ফিরিস্তি। “ছবি পাঠাও। ভিডিও পাঠাও। হায় আল্লাহ্ ! মানুষ কি মরে প্রমাণ করবে সে মরে নাই ?” বিড়বিড় করতে করতে তাজেম মাস্টার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করে আকাশের পরিস্থিতি। কোথাথেকে দুটো নেংটি পরা ছেলে সাঁতরে উঠে আসে — “মাস্টুর আজ ইস্কুল হবেক লাই ? পতকা তুলবিক লাই ?”
জাইরুল এবং হায়দার দুই ভাই। ক্লাস থ্রীতে পড়ে। অপুষ্ট চেহারায় দারিদ্রের লক্ষণ। ভোর হলেই বাওড়িয়া বিলে শাক তুলতে যায়। বনে বাদাড়ে গরু চরায়। মাঝেমাঝে বাপের সাথে ফকিরি দলে করতাল বাজায়। আধপেটা খেয়েও মুখে অনর্গল হাসি। পড়াশোনায় ভালো, কাজেও খুব উদ্যম। মাস্টারদের নির্দেশ যেন মহম্মদের বাণী। নদী পেরিয়ে বড়ো স্কুলে পড়ার শখ কিন্তু শেষ অব্দি শহরে গিয়ে গতর খাটানোই কপালে জোটে। এমনই হতভাগ্য!
আজ নস্করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারতবর্ষের বাহাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে। তাজেম মাস্টার ঝোলা পাঞ্জাবি বুক অব্দি গুটিয়ে রশিতে টান মেরে গেয়ে ওঠেন “জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে।” গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক নিরাপদ উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সুর মেলায়। জাইরুল ও হায়দার ভারী বৃষ্টির মধ্যে পোনা মাছের মতো ভাসতে ভাসতে এক গলা জলে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠোঁকে স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিকে। উপস্থিত সকলের শরীরে মজ্জায় খেলে যায় হাই ভোল্টেজ দেশপ্রেম। হায়দার ছোট ভাইকে খোঁচা মারে — “তাকা তাকা, মিজানুর মাস্টুর ফটক তুইলছে।”
ঠিক এক বছর পর, গোটা দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আন্দোলনের আগুন। টাকার জোরে কাগজ দেখিয়ে বড়লোকরা উতরে যাচ্ছে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাদ পড়ছে শুধু গরিবরা। জাইরুলের মা কাঁদতে কাঁদতে এসে পড়লে তাজেম মাস্টারের পায়ে — “আমাদের হায়দারের নামটো লাইরে মাষ্টুর ! আর একবার দ্যাইখ, লিশ্চয় কুথাও ভুল হ্ছে ! তুদের এই দ্যাশটোকে কি হায়দার ভালোবাসে লাই ?”