মার্গে অনন্য সম্মান দেবাশিস সেনগুপ্ত (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার
পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৩২
বিষয় – সোশ্যাল মিডিয়া, এপ
ভাঙা বাঁশি
প্রতিবছরই বান্ধবীরা সুমনাকে বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতনে যাবার কথা বলে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি,রাড়ির রক্ষণশীলতা। এবছর বান্ধবীরা এসে বাবার অনুমতি আদায় করে। প্রথমে গররাজি হলেও যখন শোনে হোটেলে নয় ওরা অপর্ণাদের গেস্ট হাউজে থাকবে আর অপর্ণাদের গাড়িতে যাবে,রাজি হয়ে যায়।
উৎসব শুরুর দিনকয়েক আগেই বেড়িয়ে পরে,
বিশ্বভারতী ঘুরে দেখবে।
খোয়াই নদীর কিছুটা দূরে অপর্ণাদের গেস্ট হাউজ। ভোরে রওনা দিয়ে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যায়। খেয়ে,বিশ্রাম নিয়ে সবুজ বনানীর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খোয়াই-তীরে। খোয়াই এখন শুকনো পায় হেঁটে পার হওয়া যায়। সুমনা ছাড়া সবাই এসেছে। কবিগুরুর স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনে এসে সুমনার এক অন্য অনুভূতি।
হঠাৎ খোয়াই-এর ওপার থেকে ভেসে এল বাঁশির সুর—
” হৃদয়ে হৃদয় আসি মিলে যায় যেথা,
হে বন্ধু আমার…
একটার পর একটা গান।
“ফুল বলে ধন্য আমি মাটির ‘পরে,” ” আমি যখন তার দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই।” সুরমুর্ছনায় ঝঙ্কৃত সুমনার হৃদয়। মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে। সন্ধ্যা নামছে ফিরতে হবে ; বান্ধবীদের ধাক্কায় সম্বিত ফেরে।
বিকেল হলেই বাঁশির সুর ওকে টানত, যেতে বাধ্য করত খোয়াই-পাড়ে। বসন্ত উৎসব নয় সুমনার হৃদয়ে বইছে নব বসন্ত বাতাস। তৃতীয় দিন চলে গেল ওপারে।
বাঁশি তখন সুর-” পাগলিনী, তোর লাগি কী আমি করিব বল”। সুমনা এগিয়ে যায়। আলাপ শুরু।
ছেলেটি মধ্যবিত্ত, অবস্থা সচ্ছল, বিএ পাশ, নিজেদের জমির চাষবাস দেখছে। ক্ষেত নির্ভর রোজগার। এ সবে মন নেই সুমনার। মন বাঁশির সুরে। যেকদিন ছিল হ্যামলিনের বাঁশির মতো রোজ টেনে আনত খোয়াই পাড়ে।
উৎসব শেষ, ফেরার পালা। মুঠোফোনের নম্বর আদান প্রদান করে ফিরে আসে।
যোগাযোগ হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, চলেছে মন দেওয়া নেওয়া। বাঁশির সুরই এখন সুমনার হৃদস্পন্দন।
বাড়ির অমতে বিয়ে করে সুমনা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পুত্র সন্তানের মা।
প্রায় নবছর অতিক্রান্ত। অতিসচ্ছল জীবন যাপন করা সুমনা এই জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠছিল।
অনমিত্র ও বুঝতে পারছিল। চেষ্টা করছিল কিছু করার। ছোটবেলার বন্ধু বসন্তবিলাস রিয়েলস্টেট- ব্যবসায়ী। প্রভাবশালীদের বদান্যতায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। চাষবাসের সাথে ওর ব্যবসায় ম্যানেজারের কাজে যোগ দিল। সুমনাকে একটু ভাল রাখার তাগিদে।
কাজের সুবাদে বসন্তর এ বাড়িতে আসা। ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনেই বেশি। নিত্য নতুন উপহার সুমনার জন্য ; সিনেমা দেখা, বেড়ানো। ছেলে স্কুলে গেলেই বেড়িয়ে পরা ; হঠাৎ বাড়ি আসলে দেখা পাওয়া যায় না। তার রুটিন অনমিত্রর সাথে যতটা মেলে তার চেয়ে বেশি বসন্তের সাথে। বাঁশির সুরের চেয়ে গাড়ির হর্ন এখন তার বেশি প্রিয়। বসন্তে আজ কালবৈশাখীর আভাস।
অনমিত্র বুঝতে পারে সুমনা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা করে, কাজ হয়নি, অশান্তি বেড়েছে। হাল ছেড়ে দেয়।
এভাবেই চলতে থাকে। এ যেন অন্য সুমনা। এদিকে ব্যবসায় অনমিত্ররেও পরিচয় হতে থাকে। জমি বিক্রি করে নিজেই ব্যবসা শুরু করে।
একদিন রাতে সুমনা আর ফেরেনি, ফোন বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে বসন্তের সাথে চলে গেছে।
বিবাহিত বসন্ত নতুন সংসারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে। ভুল ভাঙ্গে সুমনার। বসন্তর ব্যবসাও পড়ন্ত।
ইতিমধ্যে সততা ও নিষ্ঠায় অনমিত্রর ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থ, গাড়ি, বাড়ি তার মুঠোয়।
আবার বসন্ত উৎসব । অনমিত্র খোয়াই-পাড়ে শুয়ে, পাশে ছেলে। হঠাৎই সুমনা এসে তার পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। ক্ষমা করতে বলে।
ছেলের মুখ চেয়ে অনমিত্র চুপ। সুমনা ওকে
“হৃদয়ে হৃদয় আসি মিলে যায় যেথা” গানটা ধরতে বলে।
অনমিত্র তার হাতে ভাঙ্গা বাঁশিটা তুলে দেয়।