কিছু অসহনীয় গ্রিক পুরাণের কাহিনী – লিখেছেন দেবলীনা রায়চৌধুরী

শ্রীমতী দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জী, আ্যামিটি ইউনিভার্সিটির (কলকাতা) (Amity University) শিক্ষিকা। রাঁচি ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত শ্রীমতী দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জী, সরোজিনী নাইডু কলেজের অধ্যাপক(অতিথি) ও ইন্দিরাগন্ধি নেশন্যাল ওপেন ইউনিভার্সিটির(IGNOU University) সাথেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তিনি English এ তাঁর M.Phil ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, এবং Symbology র উপর ডিপ্লোমা করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের পুরাণ, symbol (চিহ্ন-তত্ত্ব) ও প্রাচীন সংস্কৃতি বিষয়ে বাস্তবসম্মত বিচার ও চিন্তাধারা সহকারে গবেষণায় সফল ও বর্তমানেও সেই বিষয়ে গবেষণায় লিপ্ত । তিনি Ooruni Foundation এর পক্ষ থেকে "Working Woman Award" এ ভূষিত হয়েছেন। তাঁর লেখা 'পুরাণ' বিষয়ক বই ও কবিতার সংকলন মিলিয়ে মোট ৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
ইংরেজির Uncanny শব্দটি বলতে বোঝায় যা কিছু হয় ভৌতিক নয় অপার্থিব না হলে রহস্যজনক তেমন কিছু বিষয় যা অন্তর্নিহিত আছে প্রাচীন মিথ-সভ্যতায় অর্ধস্বচ্ছ পর্দার আড়ালে।
গ্রীক মিথলজি – এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে ঝকঝকে রঙের বাহার। আসলে 12 টি অতি প্রাচীন পুরাকথার মধ্যে গ্রীক পুরাণ যে সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় তা বললে অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য তার কারনও আছে। মানুষের মনস্চক্ষুকে আতঙ্কে বিস্ফারিত ও চেতনাকে রূপকথায় আছন্ন করার সব কটি রসদ আছে এতে। ষড়যন্ত্র, হিংসা, প্রেম, অবসাদ, ত্যাগ , হিংস্রতা; এই সবকিছুতে গ্রীক পুরাণ কানায় কানায় পূর্ণ।
আজ গ্রীক পুরাণ থেকে কিছু মন-কেমন করা গল্প বলব। নাহ্, শুধু মন-কেমন করা নয়, মন বিচলিত করা, বিক্ষিপ্ত করা মিথ বলব খানকয়েক আর তারপর? তারপর, বরং আলোয় একবার দেখে নেওয়া যাবে এর নির্যাস কারনটিকেও।
ষড়যন্ত্র, বিদ্বেষ, নিরাপত্তাহীনতা, উত্তেজনা, যৌনতা, প্রতিশোধস্পৃহা – গ্রীক পুরাণে এইগুলির অভাব কিছুমাত্র নেই। তার সূত্র ধরে বলব কিছু ঘৃণ্য, অভাবনীয় পারিবারিক খুনের মিথ, ও পরিবার-মধ্যস্থ হত্যালীলা।
ইংরেজিতে Parricide বলে শব্দটির পরিসর কিন্তু বেশ বড়। কথাটির বাংলা তর্জমা করলে যে শব্দ পাওয়া যায় তা হলো গুরুহন্তা। এই শব্দটির অর্থ হলো গুরুজনকে হত্যা করা – তার মধ্যে মাতৃ বা পিতৃ হত্যাও পরে। গ্রীক পৌরাণিক গল্পগুলিতে এর সত্যি অভাব নেই। তার সাথে আছে Prolicide এর কথা। এর কোন বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। এর অর্থ হলো সন্তানকে হত্যা। জন্ম দিয়েছেন যিনি, সেই মাতা বা পিতার নিজের সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করার রক্তাক্ত কাহিনি।
কোথাও একটা ধাক্কা লাগল ভাবতে? লাগারই কথা। সেই সব অস্বাভাবিক শ্বাসরোধ করা গল্প নিয়ে আজকের UNCANNY MYTHS এর তৃতীয় অধ্যায়।
অলিম্পিয়ান দেবতাদের জমকালো রাজত্ব শুরু হওয়ার আগে ছিল অতিকায় দানবের মতো একদল অতিমানব তারা টাইটন নামে পরিচিত ছিল। প্রমিথিউস, প্যান্ডরা, হাইপেরিয়ন প্রভৃতি ছিলেন নামকরা টাইটন। শুরু সেখান থেকেই।
এই টাইটনদের দুটি প্রজন্মেই দেখা যায় নিজের পিতা ও শিশুসন্তানকে হত্যার প্রয়াস। ইউরেনাস ও গেইয়ার 12 টি সন্তান ও তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ক্রোনাস তার মায়ের ডাকে সাড়া দেন ও পিতা ইউরেনাসকে নির্মম ভাবে হত্যার চেষ্টা করেন। আবার এই ক্রোনাসই নিজের সাম্রাজ্যের ও রাজত্বের প্রতিদ্বন্ধী নিরসন করতে নিজের সবকটি সন্তানকে খেয়ে ফেলেন। জিউস তার মা রীয়ার জন্য বেঁচে যায়। আর বড় হয়ে প্রথমেই হত্যা করে পিতা ক্রোনাসকে। বেঁচে ওঠে আরও 7 ভাইবোন তার। শুরু হয় অলিম্পিয়ানদের রাজত্ব বা যুগ।
প্রতিশোধস্পৃহা! গ্রীক রাজকীয় পরিবারগুলির শিরায় শিরায় প্রবাহিত। House of Tantalus এর কথা ভাবুন। পর পর শুধু খুনের কাহিনী। রাজা Tantalus জিউসের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন, সুযোগ বুঝে নিমন্ত্রণ করলেন দেবতাদের। মহার্ঘ ও রাজোচিত ভোজের ব্যবস্থা করলেন। খেতে বসে ক্রুদ্ধ হলেন দেবরাজ। মাংসের নানা পদের একটি কি জানেন? রাজা ট্যানট্যালাস দেবতাদের অপবিত্র করতে নিজের পুত্র Pelops কে হত্যা করে, রান্না করে ভোজ দেন। অবশ্যই জিউস এই রাজাকে দেন ভয়ংকর এক শাস্তি। আর ডিমেটার বাঁচিয়ে তোলে মৃত রাজপুত্রকে। পরে তার নামেই একটি রাজ্যের নাম হয় পেলপোন্নেশিয়া। জিউস কিন্তু শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, দিয়েছিলেন অভিশাপ। এই অভিশাপে, গোটা পরিবারের 3টি বংশ ধরে রক্তাক্ত ইতিহাস প্রতিধ্বনি করতে থাকে।ট্যানট্যালাসের অন্য দুই ছেলের মধ্যে শুরু হয় ঈর্ষার দ্বৈতসংগ্রাম।
আত্রিউস (Atreus) ও থাইস্টেস (Thystes) এই দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব হয় স্বর্গের এক সোনালী ভেড়ার লোম নিয়ে (golden fleece)। আত্রিউসের থেকে কৌশলে এই অসামান্য বস্তুটি নিয়ে নেন তার ভাই। ক্ষিপ্ত আত্রিউস জ্বলতে থাকেন; তিনি থাইস্টেসের দুটি শিশু সন্তানকে কেটে রান্না করে ভোজ খাওয়ান থাইস্টেসকেই। পরে তা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ বাবা প্রতিশোধ নিতে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেন। আপোলোর ইঙ্গিতে নিজের মেয়ে পেলোপিয়াকে (Pelopia) ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেন। নিজে মারা গেলেও রেখে যান আত্রিউসের মৃত্যুবাণ। জন্মায় আগিস্থাস (Ageisthus), বেড়ে ওঠে আগামেমনন ও মেনেলসের সাথে সকলের অজান্তে।
চেনা লাগছে নাম দুটি? ট্রয়ের সেই যুদ্ধের দুই বীর। মেনেলসের স্ত্রী হেলেন প্যারিসের সাথে ট্রয়ে পাড়ি দেওয়ার পর গোটা গ্রীস যুদ্ধের দামামা বাজায়। আগামেমনন সেনাপতিত্ব করেন। কিন্তু আর্টেমিস বাধ সাধেন। এই যুদ্ধের দেবী চান অপাপবিদ্ধ সদ্যযৌবনার তাজা রক্ত। রাজার ভুমিকা পিতার চেয়ে বড়। আগামেমনন ডেকে পাঠান নিজের মেয়ে ইফিজিনিয়াকে।তার মা ক্লিটেমনেস্ট্রা সাজিয়ে দেন মেয়েকে। মা যে জানেন মেয়ের বিয়ে বীর আকিলেসের সাথে। যুদ্ধে গেছিলেন আগামেমনন। জিতে ফিরে আসেন মায়াসিনিতে। তার স্ত্রী নয়, অপেক্ষা করছিল তার মৃত্যু। ক্লিটেমনেস্ট্রা ও আগিস্থাস মিলে হত্যা করেন আগামেমননকে। নাহ্, তাও থামেনি। তারপর ক্লিটেমনেস্ট্রা ও আগামেমননের ছেলে ওরেষ্টাস মাতৃহত্যা করে সে পাপের রূপক ইউমেনাইডদের তাড়নায়, অনেক ঘুরে আথেনার কৃপায় মুক্ত হন।
নাহ্ এখানেও গ্রীক পুরাণ থামেনি। জেসনের গল্পে তার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে তার ডাইনিবিদ্যায় পারদর্শী, সুন্দরী স্ত্রী মেদেয়া বিষ মাখানো গাউন উপহার দেন জেসনের ভাবী বৌ গ্লসেকে (Glauce)। ভাবী বৌয়ের মৃত্যুর পরেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে জেসন দেখে মেদেয়া উড়ে চলে যাচ্ছে তার উড়ন্ত রথে, সাথে তাদের দুটি শিশু সন্তানের মৃতদেহ। বলা বাহুল্য, মা মেদেয়া তার স্বামীর প্রতি প্রতিশোধের ইচ্ছাকে মান্যতা হত্যা করেন পুত্র দুটিকে।
অভিডের মেটামরফোসিসে ফিলোমেলের কাহিনীটাই বা কম কি? প্রক্নে ও ফিলোমেল দুটি বোন, হরিহর আত্মা তারা। প্রক্নের বিয়ে হয় টেরেউসের সাথে। ফিলমেল তার দিদির সাথে দেখা করতে আসে ওর শ্বশুরবাড়ির দেশ ফোকিসে। কামতাড়িত টেরেউস রেয়াৎ করেননি মিষ্টি মেয়ে ফিলোমেলকে। নির্মমভাবে শ্লীলতাহানি করে কেটে দেয় তার জিব। কিন্তু চুপ থাকেনি মেয়েটি। সেলাই করে দিদিকে বলে দেয় তার দুর্ভাগ্যের কথা। জ্বলে ওঠে দিদি প্রক্নে। প্রতিশোধের আগুন মাথায় তার। রাতে খাবার টেবিলে টেরেউসের সামনে রাখা হয় একটি শিশুর কাটা মাথা। শিশুটি অন্য কেউ নয় , তাদেরই ছেলে ঈটিস (Itys)। অভিডে আমরা এই তিনজনকেই 3 টি পাখিতে রূপান্তরিত হওয়ার কথা পাই। যার মধ্যে ফিলোমেল পরিণত হয় নাইটিঙ্গেল পাখিতে। প্রচলিত ধারণা ছিল নাইটিঙ্গেলের মিষ্টি গান নাকি তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী। ওই যে কবি Shelley বলেছিলেন Our sweetest songs are those that tells of saddest thoughts।
মনোবিজ্ঞানী Katrina Schuman ও Michael Ross এর মতে প্রতিশোধের এই দুর্নিবার ইচ্ছা আসে অন্যদের ক্ষতিগ্রস্থ করার প্রবল ইচ্ছায়। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন এটা নিউরোটিকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এবং এই প্রবনতার মুল কারন নিরাপত্তাহীনতা বা Insecurity feeling । তেমন মানসিক অবস্থায় মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়। জীবনযাত্রা, সম্পর্ক, নীতিজ্ঞান, সমাজ, সব ফিকে হয়ে যায়।
গ্রীক মিথোলজির পরিসর বিশাল। এই মিথের প্রকৃতি অন্যরকম – বড়ই প্রতিক্রিয়াশীল, উদ্দাম ও অসংযত। তবে মন ছুঁয়ে যাওয়া মিঠে কাহিনীও ঢের আছে। তবে কি না, Uncanny Myths এর মাধ্যমে নিয়ম বহির্ভুত মিথ গুলোই তুলে ধরব আবছা হয়ে আসা সব প্রাচীন সভ্যতার টুকরো অস্তিত্বকে।
এই গল্পগুলি থেকে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মাননা গ্রীক ক্লাসিক নাটকের। 3 গ্রান্ড মাস্টার্স-এর উপহার – গ্রীক ট্র্যাজেডি।
পড়তে পারেন :
Agamemnon – Aeschylus
Choephori – Aeschylus
Medea – Euripedes
Thyestes – Seneca.
Iliad – Homer
Metamorphosis – Ovid
Theogony – Hesiod
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।