• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় দেবব্রত রায়

রাধা

বাইরের আকাশে তখন নিটোল একটা চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নার নীলচে আলোয় ভেসে যাচ্ছে আকাশ-পাতাল । আধার গেলা কেলেখড়িসের মতোই হা-ক্লান্ত পিচরাস্তা,মাঠ-ঘাট—সসাগরা ধরিত্রী যেন চাঁদনিআলোয় একেবারে ঝকমক করছে ! যদিও,রাধা এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না তবে, মাথাটা অনেকখানি কাত করলে ঘুলঘুলির মতো ঝিঁটেবেড়ার খুপরি জানলাটা দিয়ে ঢাউস চাঁদটার সামান্য একটু অংশ-ই মাত্র সে দেখতে পাচ্ছিল। আসলে,এতক্ষন ধরে রাধা ঘরের মেঝেই জলকাদার উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ওর শাশুড়ি পদ্মমণি ঘর থেকে বেরোবার সময় রাধা-র মাথাটা দেয়ালে সজোরে ঠুকে দিয়ে বলেছিল,হারামজাদি, জোয়ান ভাতারটাকে খেয়েচু,আখুন আবার লালজুর মন্দিরে কিত্তন শুনতে যাবার রস হইচে ! জানুসনাই,আইজ রেতে উখানে ফাগুয়া হব্যাক !
দেয়ালে একটা ধাক্কা খেয়ে রাধার জ্ঞান হারানোর সময় ওর পায়ে লেগে জলের কলসিটা ভেঙে গিয়েছিল। অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই সে শুনতে পেয়েছিল বাইরের থেকে টিনপাতের দরজায় হাঁসকল লাগাতে লাগাতে তার শ্বশুর আর,শাশুড়ি-র গজগজানি ! জ্ঞান ফিরে আসার পর রাধা কপালে এমন একটা টনটনানি ব্যাথা অনুভব করলো যে ভুষো-অন্ধকারের মধ্যেও নিজের কপালে হাত বোলাতে গিয়ে “বাবাগো ! “বলে কঁকিয়ে উঠল সে ! বুঝতে পারলো,খুব জোরেই লেগেছে কপালটায় ! অবসন্ন শরীরে ওইভাবে শুয়েশুয়েই রাধা কাঁথের খুপরি জানলাটা দিয়ে সেই ঢাউস চাঁদটার একচিলতে অংশ দেখতে দেখতে একসময় নিজের কপালের যন্ত্রণার কথাটা যেন ভুলেই গেলো !
ঠিক এরকম একটা চাঁদনিরাতেই মাধবপুরের দোলের মেলায় বৃন্দাবনের সঙ্গে ওর আসনাই হয়ে গিয়েছিল ! লজ্জা-হায়া সবকিছুর মাথা খেয়ে সে রাতে বৃন্দাবনের ভালোবাসার হরপা বানে যেন একেবারে উথাল-পাথাল হয়ে ভেসে গিয়েছিল রাধা ! সেদিন নিশিগ্রস্তের মতো সত্যিসত্যিই একটা অদ্ভুত ঘোরে পেয়ে বসেছিল ওদের দুজনকেই ! রাধা সেবার মাধবপুরে ওর পিসির বাড়িতে এসেছিল দোলের মেলা দেখতে। পিসি বলেছিল,মাধবপুরের দোলের মেলা, সে তো এমনিসেমনি মেলা লয়, যেন বিশ্ববোহ্মাণ্ডি এসে জড়ো হয় সিখেনে !
বৃন্দাবন ছিল রাধার পিসতুতো দাদা মঙগলের বন্ধু। মাধবপুর থেকে প্রায় আট-দশ কিমি দূরের একটা গ্রাম চূড়ামণিপুর থেকে সেবার বৃন্দাবনও এসেছিল দোলের মেলা দেখতে। মঙগলই আগবাড়িয়ে রাধার সঙ্গে বৃন্দাবনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মানে,গাঁয়ে-ঘরে যেমন আলাপ-পরিচয় হয় আর কি ! মঙগল বৃন্দাবনকে বলেছিল, “আমার মামাত বুন বটে,ইবার উচ্চুমাধ্যমিক দিবেক ! ” মঙগলের কথার ধরনে হি হি করে হেসে উঠেছিল রাধা। আর, বৃন্দাবন ওর সেই মোহিনী রূপ দেখেই যেন একেবারে পাগলের মতো প্রেমে পড়ে গিয়েছিল ! তারপর,সপ্তাহ ফিরতে না ফিরতেই, ওদের রকমসকম দেখে দু-পক্ষের বাপ-মা, পাড়ার মাতব্বরজনেরা মিলে একটা দিন ধার্য করে রাধা আর,বৃন্দাবনের চার হাত এক করে দিয়েছিল ! বিয়েতে কত হৈচৈ-ই না হয়েছিল ! মা বিশালাক্ষী-র থানের সিঁদুর দিয়ে বৃন্দাবন ওর সিঁথি আর,কপালখানা একেবারে টকটকে করে রাঙিয়ে দিয়েছিল ! বন্ধু-বান্ধবী,পাড়ার বউদিদিরা ওদের বাসর ঘরে কী আমোদ আহ্লাদটাই না করেছিল কিন্তু ,অত আনন্দ-আমোদের বিয়েটাও আর সুখের হলো কৈ !
সেই ছোটোবেলার থেকেই তুষু আর,দোল পরব ছিল রাধার কাছে দুর্গাপূজার থেকেও প্রিয় পালপার্বণ ! গতবছর সেই দোল পরবের আগের দিনই বৃন্দাবন বলেছিল,ইবার টাউন থিক্যা তুমার জন্য রঙ,পিচকারি লিয়ে আসব !
রাধা পিছন থিকে বৃন্দাবনের কানের লতিতে একটা চুমু খেতেই বৃন্দাবনও রাধাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর শক্ত-জোয়ান হাতে রাধাকে আদরে আদরে একেবারে পাগল করে দিয়েছিল ! শরীর থেকে শায়া-ব্লাউজ খসে পড়তেই রাধা বৃন্দাবনের বুকের ভিতরে মুখ লুকিয়েছিল !
যাব যাব করেও কী-কারণে যেন বৃন্দাবনের সেদিন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল ! বিকেলের আলো প্রায় পড়ে এসেছিল ! বৃন্দাবন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে সাইকেলটা বের করতেই ওর মা-বাপ একসঙ্গে এসে পথ আটকেছিল। বলেছিল,”এই সাঁঝবেলায় টাউনে যাসনে বাপ, জঙ্গলে মহাবাদিরা আছে ! তেনাদেরকে বিশ্বাস নাই ! মাথায় বোন্দুক ঠেকায়ে আঘুয়া করে লিয়ে যাবেক ! “কিন্তু, বৃন্দাবন কারোর কথাই শোনেনি ! রাধাকে যে সে কথা দিয়েছে টাউন থেকে তার জন্য রঙ,পিচকিরি এনে দেবে তাই, বাপ-মায়ের হাজার বারণ সত্ত্বেও সে হুড়মুড় করে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল !
তারপর,সারারাত চূড়ামণিপুরের কেউ আর দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সেদিন ! রাত্রি আটটা নাগাদ গভীর জঙগলে একনাগাড়ে বন্দুকের আওয়াজ আর,হাল্লামাল্লা শুনে গাঁয়ের লোক প্রমাদ গুনেছিল ! তারা একে একে এসে ভিড় জমিয়েছিল বৃন্দাবনদের উঠোনে কারণ, তারা জানত সাঁঝবেলায় গাঁ থেকে একমাত্র বৃন্দবনই টাউনে গেছে রাধার জন্য রঙ কিনে আনতে তাছাড়া, বৃন্দাবন ঐ খুনিগুলোর বিরুদ্ধে গাঁয়ের সবাইকে এককাট্টা করে তোলায় এমনিতেই সে ওদের শত্রু হয়ে উঠেছিল ! তবে,কিছুদিন আগেও শোনা গেছিল খুনি মহাবাদীরা জঙগল থেকে পালিয়েছে কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে খবরটা সম্পূর্ণ ভুল ! রাত আরেকটু বাড়তেই গ্রামের লোকেরা স্থানীয় পুলিশ-ফাঁড়িতেও ‘খবরি ‘পাঠিয়েছিল কিন্তু, তাতে লাভ হয়নি কিছু ! সে রাতে অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও বৃন্দাবনের ভালোমন্দ কোনো খবরই আর পাওয়া যায়নি !
পরেরদিন সকালবেলা সমস্ত জঙগলএলাকায় তল্লাশি চালিয়ে অবশেষে, পুলিশ আর, কেন্দ্রীয়বাহিনী তাদের জিপগাড়িতে করে বৃন্দাবনের রক্তে ভেজা বরফের মতো ঠাণ্ডা শরীর আর,ওর ভাঙাচোরা সাইকেলটা গভীর জঙগলের ভিতরে খুঁজে পেয়ে তুলে এনেছিল ! রাধা-র জন্য টাউন থেকে রঙ আনতে গিয়ে বৃন্দাবন একাই যেন সব রঙ নিজের শরীরে মেখে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল !
সে রাতেও পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল তবে,সে চাঁদ ছিল বরফের মতো একেবারেই সাদা । রাধা সেদিনও এমনিই মেঝেতে পড়েছিল একা-একা ! ওর খুবই ঠান্ডা লাগছিল, খুব !
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *