গল্পকথায় সায়নদীপা পলমল

ক্যান্ডি ক্রাশ

ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা তুলতেই অপ্রান্ত থেকে ফোঁস করে একটা শব্দ শুনতে পেল অভি। কাল সারাদিন অফিসে অনেক খাটনি গেছে তাই বাড়ি ফিরে বিছানায় শোওয়া মাত্রই গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে গিয়েছিল সে। তারপর আজ ফোনের শব্দে ঘুমটা খানিক পাতলা হলেও ভাঙলো না পুরোপুরি। ফোনটা তুলে ফোঁস শব্দটা শুনতে পেয়েই ঘুম জড়ানো গলায় অভি বলল, “নাগমণি চাইনা।” এই বলে ফোনটা বুকের ওপর ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
কয়েকদিন আগেই সাপখোপ নিয়ে একটা ফ্যান্টাসি মুভি দেখেছিল সে, এই মুহূর্তে সেই সিনেমার দৃশ্যগুলোই স্বপ্নের আকারে উঁকি দিচ্ছে তার মধ্যে। অভির এহেন আচরণে ওপর প্রান্তের মানুষটা কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল, তারপরেই নিজেকে সামলে আরেকবার ফোন লাগাল। ফোনটা অভি তুলেছে বুঝতে পেরেই সে তার বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “বলি কাল রাতে কি ছাইপাশ গিলে বাড়ি ফেরা হয়েছে নাকি!”
ভদ্রমহিলার গলার দাপটে ঘুমটা এবার পুরোপুরি ছেড়ে গেল অভির। সে তড়াক করে খাটে উঠে বসে বলল, “কি যে বলিস না ঘুমোচ্ছিলাম তো।”
“কটা বাজে সে খেয়াল আছে?”
“ক’টা?”
“বলবো না তুই ঘড়ি দেখ।”
“উফফ তুই না… তা এতো সাত সকালে কি মনে করে?”
“কি মনে হতে পারে?”
“আমি কি করে জানবো তোর মনে কি চলছে!”
“বাহ্… চমৎকার। যাইহোক, আজ বিকেল চারটের সময় আমার সাথে দেখা করবি কালেক্টরীর মোড়ে।”
“পাগল নাকি? অফিস আছে আমার।”
“আর আমি কি ফ্রি বসে আছি?”
“সেটা নয় কিন্তু… উইকেন্ডে দেখা করব। আজ পসিবল নয়।”
“ওহ। তোর কাছে আজকের দিনটাও অন্য সব দিনগুলোর মতোই হয়ে গেল?”
“কেন আজ আবার কি স্পেশ্যাল?”
“কিছু না। রাখছি।”
এই গলার স্বর আর রাখছির মানে অভির ভালো করেই জানা, তাই সে তড়িঘড়ি বলল, “আরে আরে কি হয়েছে বল না প্লিজ। আমার মনে পড়ছে না।”
“দরকার নেই মনে করার। সাত সকালে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তুই আজকের দিনটা ভুলে গেলি শেষমেশ!… রাখলাম।”
এরপর খুট করে একটা ফোন কাটার আওয়াজ। ধ্যাত… বলে ফোনটা পাশে ছুঁড়ে ফেলল অভি। মাঝে মাঝে এই মহিলার মাথার পোকাগুলো এমন নড়ানড়ি করে ওঠে যে অভির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

ওয়াক… শব্দটা শুনতে পেয়েই বাথরুমের দিকে ছুটলেন মিসেস সেন। দেখলেন বৌমা বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বমি করার তোড়জোড় করছে। ছেলের এই সবে একমাস হল বিয়ে হয়েছে। সুতরাং বৌমা এই বাড়িতে নতুনই বলা যায়, তাই এই বাড়িতে তার ভালোমন্দ সব দেখভালের দায়িত্ব অবশ্যই মিসেস সেনের। তিনি তড়িঘড়ি বৌমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হল মা শরীর খারাপ করছে?”
বৌমা একটু ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করতে করতে বলল, “না মানে… ওই আপনার ছেলে আমাদের এটাচ বাথটায় স্নান করছে তাই আমি ভাবলাম আমি কমন বাথটায় চলে যাই। কিন্তু…”
“আহা এতে কিন্তু কিন্তু করার কি আছে? তোমার বাড়ি, যেটায় খুশি যাবে।”
“না মানে…” বৌমা আর কিছু বলার চেয়ে বাথরুমের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখানোটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করল। বাথরুমের দিকে চোখ পড়তেই একটা ঢোঁক গিললেন মিসেস সেন, “হেঁ হেঁ… আসলে মা তোমার শ্বশুর মশাইয়ের বয়েস হচ্ছে তো তাই আজকাল এরকম একটু আধটু… আগে কিন্তু এরকম ছিলেন না।”
বৌমা চলে যেতেই দাঁত কিড়মিড় করলেন মিসেস সেন, “সারাজীবন… সারাজীবন লোকটা এইভাবে জ্বালিয়ে যাবে আমাকে। ছি ছি পরের বাড়ির মেয়ে কি ভাবল কে জানে! দুনিয়াতে আর কোন মানুষটা আছে যে এরকম পটি করে দিয়ে ফ্লাশ করতে ভুলে যায়! আর ওনার হাবভাব দেখলে তো মনে হয় যেন আমি এই ফ্লাশ করতেই জন্মেছিলাম। মানুষের এতো ভুলো মন হয় কি করে? সব ব্যাপারে ভুলো এদিকে অফিসের নামে এক্কেবারে একাই একশো, সেই বেলা তিনি কিচ্ছুটি ভোলেন না। নিজের বউ এর নাম ভুলে যাবেন কিন্তু অফিসের ছোটখাটো জিনিসও ভুলবেন না।”
রাগে গজগজ করতে করতে মিসেস সেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজেদের রুমে এলেন। রোজ লোকটা অফিস যাওয়ার সময় পরা জামাকাপড়গুলো এখান সেখানে ফেলে দিয়ে চলে যান, সব গুছিয়ে রাখতে হয় মিসেস সেনকেই। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি, খাটের ওপর তাঁর পোশাকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। উফফ… মিসেস সেন খাটের কাছে যেতেই পায়ে ঠঙ করে কি যেন একটা লাগল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা চায়ের কাপ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর শেষ তলানি চা টুকু ছুঁইয়ে পড়ছে তার থেকে। ভাগ্যভালো ধাক্কায় কাপটা ভাঙেনি। আজ সকালে মহাশয় কিসব কাগজপত্র মেঝেতে মেলে বসেছিলেন, আর এখানেই চা খেয়েছেন এবং কাগজের মধ্যে তন্ময় হয়ে গিয়ে কাপটার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। লোকটার সত্যিই কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। ছেলে বৌমা আজ রাতের ট্রেনে বেড়াতে যাচ্ছে। ওদের খাবার দাবার আর বাকি সব কিছু দেখভালের জন্য যেখানে মিসেস সেন ছুটি নিতে পারলেন সেখানে সেই ভদ্রলোক আজ আবার সাত তাড়াতাড়ি অফিস ছুটলেন। লোকটা কেন যে এরকম! সারাজীবনটা জ্বালিয়ে খেলো…

অফিসের পিওন এসে পলাশকে একটা পার্সেল ধরিয়ে দিয়ে গেল। অভি উঁকি দিয়ে পার্সেলটা দেখতে পেয়ে বলল, “ভায়া এমন রঙচঙে পার্সেল দেখছি, কি আছে গো ওতে?”
“হুঁ হুঁ সারপ্রাইজ। আজ যদি গিফট নিয়ে না যাই বউ তাহলে আমাকে আর ঘরে ঢুকতে দেবে না।”
“এ আবার কেমন সারপ্রাইজ যে বৌদি নিজেই জানে গিফট আছে।”
“বিয়ের পরের সারপ্রাইজগুলো এমনই হয় ভায়া। তুমিও বুঝবে দাঁড়াও।”
“তা গিফটটা কিসের জন্য বললে না তো। বৌদির জন্মদিন নাকি?”
“মানে? এই সেরেছে আজকে কি দিন তুমি ভুলে গেছো নাকি? মধুবনী আজ আর তোমাকে ছাড়বে না।”
“কেন কেন? কেসটা কি বলোতো? আজ তিনিও ফোন করে খুব গোঁসা করলেন আর তুমিও বলছো বিশেষ দিন। মানেটা কি?”
“আরে ভায়া আজ যে চকোলেট ডে। পত্নী এইদিন গিফট না পেলে একেবারে পেত্নী হয়ে ঘাড় মটকে দেয়। হেঁ হেঁ।”
পলাশের কথা শুনে বেশ একটু চিন্তায় পড়ে গেল অভি। হ্যাঁ, আজ ওই চকোলেট ডে না কি যেন সেটা অভির মনে ছিলনা ঠিকই কিন্তু তাদের আজ সাত বছরের সম্পর্কে মধুকে তো কোনোদিনও এই ভ্যালেন্টাইন উইক নিয়ে মাতামাতি করতে দেখা যায়নি! তাহলে এইবার কি হল! পরের মাসেই ওদের বিয়ে; বিয়ের হাওয়া লাগতেই কি মধুর মাথার পোকাগুলো নতুন হুজুগে নড়ে উঠল এ বছর! কে জানে বাবা! মাথা চুলকালো অভি। শুনতে পেলো পলাশ কাকে যেন বলছে বউয়ের জন্য স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে এই অর্গানিক চকোলেট আনিয়েছে। সে পলাশ তো আনিয়েছে কিন্তু অভি এখন কি করবে? এমন দিনে কি চকোলেট দিতে হয় কে জানে! ভদ্রমহিলা তো আবার গোঁসা করেছেন, ফোনও ধরবেন না। লাঞ্চ ব্রেকে অফিস থেকে বেরিয়ে আশেপাশের দোকানগুলোতে খুঁজলো অভি। নাহ, সব দোকানে চকোলেট শেষ। কি কান্ড! অভিকে আনমনা দেখে এগিয়ে এলো সুমিত, “আরে অভিদা হয়েছেটা কি?”
সুমিত ছেলেটা এই কিছুদিন হল অফিস জয়েন করেছে। তবে বেশ করিতকর্মা ছেলে,ওকে বললে কিছু একটা সুরাহা হলেও হতে পারে। এই ভেবে সুমিতকে সবটা খুলে বলল অভি। সুমিত ওর কথা শুনে একটা আত্মবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল, “উফফ এর জন্য চাপ নিচ্ছ! আগে বলবে তো। আমি আছি কি করতে?”
“তুই চকোলেট কিনে আনবি?”
“কিনে নয় ফ্যাক্টরীটাই একেবারে তুলে আনবো।”
“মানে?”
“মানে আর কিছুনা, আমার গার্লফ্রেন্ড চকোলেটের বিজনেস করে। হ্যান্ডমেড চকোলেট। তো ওকে বলে দিচ্ছি তোমার জন্য আজকের স্পেশ্যাল পেপার দিয়ে প্যাক করে একটা চকোলেটের বাক্স পৌঁছে দিতে।”
“উফফ বাঁচালি ভাই। এক্ষুণি বল।”
সুমিত একগাল হেসে একটু সরে গিয়ে ফোন লাগাল। তারপর ফোনের ওপারে গুজগুজ ফুসফুস করে কিসব কথা বলে ফিরে এলো অভির কাছে। সুমিতের মুখখানা একটু শুকনো।
“কিরে হল না?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল অভি। সুমিত ওর শুকনো মুখে বলল, “হলো না ঠিক নয় মানে তুমি এতো লেট করে বললে যে এতক্ষণে সব ভালো ভালো বক্সগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এখন খালি একটা কমদামী প্যাকেট পড়ে আছে।”
“কত?”
“ওই কমের একটা প্যাক। হাজারের আরকি…”
“হা… জার!” অভির মাথাটা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হল। সুমিত আগের মতোই পানসে মুখ করে বলল, “কি আর করবে বলো। তবে যাই হোক দামের চেয়েও মনটাই আসল। আই হোপ মধুবনী বৌদি বুঝবে সব।”
হাজার টাকার চকোলেটের পর আর কি বোঝার থাকতে পারে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভি। উফফ এই বিয়ের আগেই এতো বাঁশ যদি তাহলে পরে কি হবে!!!

ছুটির দিনে দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া করে একটু বই পড়া মিসেস সেনের সেই ছোটবেলার অভ্যেস। এখন প্রবীণত্বের দোর গোড়ায় এসেও অভ্যেসটা যায়নি। তবে আজকের ব্যাপার আলাদা। সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে; তাই পেটে ভাত দুটো পড়া মাত্রই রাজ্যের ঘুম এসে ভীড় করছে তাঁর চোখে। বইটা তুলেও রেখে দিলেন মিসেস সেন। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মাথায় বালিশ আর গায়ে কম্বল টেনে সেই সবে ঘুমটা একটু গাঢ় হতে শুরু হয়েছে এমন সময় ঝনঝন করে বেজে উঠল মুঠোফোনটা। বিরক্তি মুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কর্তার নাম্বার। একটু অবাক লাগল, লোকটা তো অফিস গেলে জগৎ সংসার ভুলে যায়। আজ আবার কি হল!
ফোনটা ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে একটা উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে এলো, “বলছি শোনো আজ চারটে নাগাদ আমার একটা ফাইল নিয়ে কালেক্টরীর মোড়ে আসতে পারবে প্লিজ?”
“মানেটা কি?”
“আসলে আজ পাঁচটা থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে কিন্তু আমি ওই সংক্রান্ত ফাইলটা ঘরে ফেলে চলে এসেছি। প্লিজ তুমি নিয়ে এসো।”
“ইয়ার্কি পেয়েছো? তুমি নিজেকে ভাবোটা কি? সারাজীবন আমাকে জ্বালাতন করে গেলে। এমনকি পটি করে ফ্লাশটা অবধি করতে…”
“আহা বাড়ি ফিরলে প্রাণ খুলে ঝগড়া করবে, এখন আমি খুব ব্যস্ত। কিন্তু লক্ষীটি আমার ফাইলটা ওই চারটার দিকে পৌঁছে দিও। খুব ইম্পরট্যান্ট ওটা। আর শোনো বাবুকে বলার দরকার নেই, আজ ওদের হানিমুনে যাওয়ার দিন। আজকে ওকে ব্যতিব্যস্ত কোরো না।”
“হুমম সবাই ব্যতিব্যস্ত হয় শুধু আমি ছাড়া তাই না? আমার তো কোনো মন নেই, আমার তো কোনো কষ্ট নেই… হ্যালো … হ্যালো…”
কর্তাটি সুযোগ বুঝে কখন যেন ফোনটা টুক করে কেটে দিয়েছেন। ফোনটা রেখে ফুঁসতে লাগলেন মিসেস সেন। আজ একবার লোকটা ঘরে আসুক, তারপর মজাটা দেখবে…

বিকেল চারটে বেজে ছয়। শীত সন্ধ্যে নামবে আর মাত্র ঘন্টা দুয়েক পর তাই কালেক্টরী চত্বর এখনই জমজমাট। রাস্তার ধারে হকাররা যে যার পসরা সাজিয়ে খরিদ্দার ধরতে ব্যস্ত। রাস্তার ধারের দোকানের স্টোভগুলোতে গনগনে আগুন, ওপরের কড়াই থেকে ভেসে আসছে লোভনীয় খাবারের গন্ধ। অভির হাতে হাজার টাকার চকোলেটের বাক্স, বুকের বামপাশে শূন্য পকেটের চিনচিনে ব্যাথা নিয়ে অভি শুধু দেখছে সবাইকে। অনেকক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি, তাই অভির জিভ বেয়ে অবাধ্য লালাগ্রন্থীগুলো তাদের তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। হালকা হালকা বিরক্ত লাগছে অভির। এমনিতে ভদ্রমহিলা সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়ে থাকেন যে কোনো জায়গায় কিন্তু আজ তো আবার গোঁসা করেছেন তিনি। আর বেরোবার আগে পলাশ বলল বিয়ে করতে হলে নাকি বউয়ের জন্য অপেক্ষা করাটাও শিখে নিতে হয়। মহিলা কি তবে অভিকে ট্রায়াল দেওয়াচ্ছেন নাকি কে জানে!
হাতঘড়িটা দেখে অভি যেই ফোনটা লাগাতে যাবে অমনি অভির সামনে আবির্ভুতা হলেন তিনি। পরনে একটা অরেঞ্জ কালারের শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স, কানে দুটো ছোটো দুল— ব্যাস এই তার সাজ। আশেপাশে যত যুগল ঘোরাফেরা করছে তাদের কারুর পরনে শাড়ি, তো কারুর সালোয়ার বা অন্য কোনো মেয়েদের পোশাক। কি সুন্দর করে সেজেছে তারা। কিন্তু অভির নিজের ভদ্রমহিলাটি এরকমই। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অভির একটা মেসেজে সব রাগ গলে জল, কিন্তু তাও এখনও ছদ্ম রাগের আড়ালে অপেক্ষা করছে অভির মান ভঞ্জনের চেষ্টার। সব জানা সত্ত্বেও কিছু করার নেই।
“আয়াম রিয়েলি সরি যে আমি আজকের দিনটা ভুলে গিয়েছিলাম।”
“মনে যে পড়েছে শেষমেশ এই ঢের।”
“তাই বুঝি?”
“হুঁ।”
“থ্যাংক ইউ। তা এই নে। হ্যাপি চকোলেট ডে।” এই বলে চকোলেটের প্যাকেটটা মধুবনীর দিকে বাড়িয়ে দিল অভি। মধুবনী সেটা ধরার বদলে অবাক চোখে তাকাল অভির দিকে। অভি ঘাবড়ে গেল। সুমিতের কথাই কি সত্যি, এক হাজার টাকার চকোলেটও আজকের দিনের জন্য খুবই সস্তা! মধু যদিও টাকা পয়সা নিয়ে ভাবে না কিন্তু তাও এখন মাথাটা তো বিগড়ে আছে, তাই মাথায় কি চলছে না চলছে বোঝা যায়না।
“বলছি যে দামি গুলো সব চকোলেট শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই এই হাজার টাকার প্যাকেটটাই পেলাম আরকি।”
অভি দেখল ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মধুবনীর চোখদুটো টলটল করতে লাগল জলে, “তোর কিচ্ছু মনে নেই তাই না?”
আরও ঘাবড়ে গেল অভি, “না মানে আজ তো চকোলেট ডে। আর কি?”
“আমি তোর কাছে কবে এইসব চকোলেট, টেডি বিয়ার চেয়েছি? কবে বল? না তুই কবেও দিয়েছিস আমাকে? তাহলে আজ… হাজার টাকার চকোলেট কিনলি তুই? তোর কি মাথা খারাপ?”
অভি বুঝলো কেস গন্ডগোল। এসময় দুর্বল হলে ভদ্রমহিলা আরও কথা শোনাবে, তাই অভি গম্ভীর হয়ে বলল, “দেখ এসব হেঁয়ালি আমার ভালো লাগে না জানিস। তাহলে সকালে সোজাসুজি বললেই পারতিস কি বলতে চাইছিস। আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তোর মনের তল পাওয়ার সাধ্যি আমার নেই। আমার বিরক্তি লাগছে এবার।”
“সরি ফর ইরিটেটিং ইউ।” শব্দগুলো উচ্চারণ করেই বড় বড় পা ফেলে মধুবনী এগিয়ে গেল পাশের দিকে। হতভম্ব হয়ে গেল অভি। এমনটা তো হয়না সচরাচর, সে ঘুরে রাগ দেখালে মধু অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু আজ যেন সবই গোলমাল লাগছে। অভি দেখল মধু এগিয়ে গিয়ে আহারে বাহারে রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেল। ভ্রু’টা কুঁচকে গেল অভির। সেও ছুটল পেছন পেছন। আহারে বাহারের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল মধুবনী, “আমার প্যাকেটগুলো রেডি করেছেন তো?”
“একদম ম্যাডাম।” এই বলে কাউন্টারের ছেলেটা একটা প্রকান্ড সাইজের খাবার বোঝাই প্যাক রাখলো মধুবনীর সামনে। তারপর একগাল হেসে বলল, “দুটো প্যাকেট এক্সট্রা দিয়েছি ম্যাডাম। আপনি এরকম একটা ভালো কাজের জন্য খাবার নিচ্ছেন তাই ওই দুটো আমাদের তরফ থেকে ছোট্ট কন্ট্রিবিউশন।”
“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আজ আমার অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।”
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পুরোটা দেখছিল অভি। মধুবনীর শেষ কথাটা শোনা মাত্রই বুকে একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো সে। মুহূর্তের মধ্যে স্মৃতির অতলে সে পিছিয়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগে। তখন ওরা কলেজে পড়ে। সদ্য প্রেমের শুরু, লজ্জাভাবটা তখনও ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আজকের দিনে এরকমই বিকেলে ওরা গিয়েছিল পার্কে। একটা বেঞ্চে বসে এটা সেটা কথা বলছিল। এমন সময় একটা বাচ্চা আসে ওদের সামনে। বাচ্চাটার কাঁধে একটা গোল তারে আটকানো হরেক রকম ক্যান্ডি।
“ও দাদা ও দিদি লজেন নেবে লজেন?”
“না না যা এখান থেকে।” বাচ্চাটাকে তড়িঘড়ি না বলেছিল অভি। বাচ্চাটা কাতর মুখে বলেছিল, “একটা অন্তত নাও না গো। খুব খিদে পেয়েছে। আজ ওই কি চকোলেট ডে না কি যে ওই জন্য কেউ আমার লজেন কেনেনি।”
অভি আর কিছু বলার আগেই একটা দশ টাকার নোট বাচ্চাটার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল মধুবনী। তারপর ওর কাছ থেকে দুটো লেমন ক্যান্ডির প্যাকেট নিয়ে আবার বাচ্চাটার হাতে একটা চিঁড়ের প্যাকেট গুঁজে দিয়েছিল। বাচ্চাটা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল একবার, তারপর ছলছল চোখে ছুট লাগিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কিছুটা দূরে খেলতে থাকা আরও দুটো বাচ্চার কাছে। তারপর অভিরা দেখতে পেয়েছিল কিভাবে ওই ছোট্ট চিঁড়ের প্যাকেটটা ওরা তিনজনে ভাগ করে খাচ্ছিল পরম আনন্দে। অভি নিজেই নিজের সমর্থনে আচমকা বলে উঠেছিল, “আমি এইসব বাচ্চাদের টাকা পয়সা দেওয়া একদম পছন্দ করি না। এরা সব নেশা করে ওই টাকায়।”
“আমি জানিনা রে।। হয়তো তুই ঠিকই বলছিস কিন্তু যদি না নেশা করে, যদি সত্যিই টাকাটার প্রয়োজন হয় তখন? দেখেছিস তো সামনে, একটা চিঁড়ের প্যাকেট কিভাবে ভাগ করে খাচ্ছে ওরা। ওদের মা বাবাও তো ওদের দেখেনা।”
“কি করবি বল?”
“কিছুই কি করতে পারিনা না?”
“কি আর করবি?”
“আমি শুনেছি অনেক এন.জি.ও ওদের সাহায্য করে। যদি তাদের সাথে যোগাযোগ করা যেত…”
“হুমম সেটা করা যেতেই পারে।”
“আর অভি শোন না”
“কি?”
“সবাই তো এই সপ্তাহটা অনেক রকম গিফট কিনে অনেকরকম ভাবে উদযাপন করে। কিন্তু আমরা যখন চাকরি পেয়ে যাবো তখন কি আমরা পারিনা বছরের একটা দিন অন্তত এই বাচ্চাগুলোর সাথে উদযাপন করতে?”
“পারি।”
“প্রমিস? ভুলবিনা কখনও?”
“প্রমিস। কক্ষনো ভুলবো না। আমরা চাকরি পাওয়ার পরের চকোলেট ডেটা তোর মনের মত করে সেলিব্রেট করব।”
“থ্যাংকস। এই নে, হ্যাপি ক্যান্ডি ডে মিস্টার।” এই বলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে একটা লেমন ক্যান্ডি অভির মুখে ভরে দিয়েছিল মধুবনী।
আজ দুজনের চাকরি পাওয়ার পর ওদের প্রথম চকোলেট ডে। আর অভি কিনা বেমালুম ভুলে গেল প্রমিসটা!

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বিকেল চারটের সময় কালেক্টরীর মোড়ে এলেন মিসেস সেন। মাথায় আগুন জ্বলছে তাঁর। লোকটা কোথায় কে জানে! আজকে এখানে এতো লোকজনের আনাগোনা কেন কে জানে! এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে লোকটাকে দেখতে পেলেন তিনি। উশকো খুশকো মুখে একটা হাসি লাগিয়ে এগিয়ে আসছেন। লোকটা কাছে আসতেই ফাইলটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন মিসেস সেন। লোকটার মুখের হাসি আরেকটু চওড়া হল যেন।
“এতো দাঁত বের করার কি হল?”
“বলছি গিন্নি যাবে নাকি আহারে বাহারেতে?”
“তোমার মাথা খারাপ জানি কিন্তু আমারও কি খারাপ নাকি? তোমার মতো পেট পাতলা লোকের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে আবার যায়!”
“আহ গিন্নি। চলোই না। অতো খাবার আমি একলা হাতে বইতে পারব না।”
“অত খাবার! মানে… একমিনিট, আজকে কি…”
“আমি জানতাম সংসারের কাজের চাপে তুমি ভুলে যাবে তোমার স্বপ্নটা। কিন্তু আমি যে তিরিশ বছর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তোমার স্বপ্ন আমি কোনোদিনও ভুলব না।”
“তুমি…” মিসেস সেনের চোখ ছলছল।
“নাও চলো আর কান্নাকাটি নয়।”
পশ্চিম দিগন্তে আবীর মেখে সেজেছে আকাশ। বাচ্চাগুলো পেট পুরে খেয়ে চলে গেছে যে যার কাজে। ঘাসের উপর আঁচল ছড়িয়ে বসলেন মিসেস মধুবনী সেন, পাশে তার বেস্ট হাফ মিস্টার অভিরূপ সেন। হঠাৎ কি যেন খেয়াল হতে মিসেস সেন বললেন, “তোমার মিটিং ছিল না? ফাইলটা…”
মুচকি হেসে ফাইলটা মিসেস সেনের হাতে দিয়ে মিস্টার সেন বললেন, “খুলে দেখো এটা।”
ফাইলটা খুলতেই চমকে উঠলেন মিসেস সেন। ওটার মধ্যে একটা ল্যামিনেশন করা কোলাজ যেখানে ধরা রয়েছে বিগত তিরিশ বছরের চকোলেট ডে’র স্মৃতি। মিসেস সেনের চোখের কোল দুটো আবার আদ্র হয়ে উঠল। মিস্টার সেন তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন,
“আমার সব মিথ্যে কথার কারসাজি
তোমার আদর পাওয়ার নামে,
আমার ঠোঁটে অবাধ্যতার ফুলঝুরি
তোমার মান ভাঙানোর গানে।
হ্যাপি ক্যান্ডি ডে মিসেস সেন।”
মিসেস সেন দেখলেন তাঁর হাতের মুঠোয় চকচক করছে একখানা লেমন ক্যান্ডির প্যাকেট।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।