গদ্যানুশীলনে দেবাঞ্জন মহাপাত্র

চক্ষু দান

পার্থকে রাস্তা দিয়ে হন্ত-দন্ত ভাবে হাঁটতে দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম , ” কোথায় যাচ্ছিস আর তোকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?কী হয়েছে? কেয়া কেমন আছে? কিছুদিন আগে দুজনে এক জায়গায় ঘুরতে গেছিল আর সেখানে এক দুর্ঘটনায় পার্থর কিছু না হলেও কেয়ার চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায়।

পার্থ উত্তর দিল , ” আজকে মেডিক্যাল কলেজে একটা সেমিনার আছে সেখানেই যাচ্ছি , আমার জন্যই কেয়ার আজ এই অবস্থা , ওকে সুস্থ করতে না পারলে নিজেই ভিতরে জ্বলে পুড়ে মরব। ওর মানসিক অবস্থা দেখে ওকে একা ছাড়তে মন চাইল না। বললাম , আমি ও যাবো তোর সাথে। অফিস ছুটি নিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম সেমিনারে। দুজনে মিলে পুরো সেমিনারটা শুনলাম , বুঝলাম। তারপর ওকে নিয়ে দুজনে বাড়ি ফিরে এলাম।

এভাবে দুদিন কাটার পর অনেক ভোরবেলায় আমার ঘরের কলিং বেলটা বাজতে দরজা খুলে দেখি পার্থ দাঁড়িয়ে। ওকে ভিতরে আসতে বললাম ও বলে , ” চল , মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফোন এসেছিল একটা চক্ষুদাতা পাওয়া গেছে। তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে পড়ি ওর সাথে। গাড়িতে বসে ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম সেদিন সেমিনারে ওর নম্বরটা দিয়ে এসেছিল তাই আজকের এই ফোন কল।

চক্ষুদাতা বিনা পয়সায় তার চোখ দান করছে। কেয়াকে এডমিড করিয়ে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম সুসংবাদের। প্রায় দুঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে সুখবরটা দিতে পার্থর জীর্ন , ক্লান্ত, সিক্ত মুখে আনন্দের অশ্রু ঝরে পড়ল। কেয়ার সাথে দেখা করা গেলে ওর চোখের বাঁধন খুলবে তিনদিন পর। কেয়ার শারীরিক সুস্থতার খবর পেয়ে কেয়ার বাড়ির লোক চলে গেলেও , পার্থকে কেয়ার কাছ থেকে সরানো যায় নি। ও তিনদিন ঠায় বসেছিল কেয়ার চোখে চোখ রেখে , মানসিক কষ্টগুলোকে দূর করার অপেক্ষায়।

দিনটি ছিল ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, যেদিন কেয়ার চোখের ব্যান্ডেজটা খুলে দেওয়া হবে। কেয়ার আবদার অনুযায়ী পার্থ আজকে একটা লাল পাঞ্জাবি আর একগুচ্ছ লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে কেয়ার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আলতো আলতো ভাবে চোখ খুলে পার্থকে দেখতেই কেঁদে ফেলে। পার্থ গিয়ে জড়িয়ে ধরে আর তাদের নয় বছরের ভালোবাসার পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তার হাতে আংটি পরিয়ে দেয়।‌

ঠিক এমনই সময় দরজায় টোকা দেয় , আমাদেরই বয়সি এক যুবক। সেই একই সাজে লাল পাঞ্জাবি আর হাতে গোলাপের তোড়া দেখে চিনতে পারলাম ইনি হচ্ছেন চক্ষু দাতার প্রেমিক।আজ সকালে চক্ষু দান করার পর Operation thater এ মারা যায় মেয়েটি। ছোটবেলা থেকেই একটা রোগকে সঙ্গে নিয়ে বড় হচ্ছিল তাই আজ operation thater এ মৃত্যু। ‌

ছেলেটার হাতে ফুল দেখে বুঝলাম হয়তো কেয়াকে দিতে এসেছে , তাই ওকে নিয়ে কেয়ার বেডের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ছেলেটি মৃদু কন্ঠে বলেছিল, ” প্রতি valentine’s day তে ওই টুকু উপহার আমি দিই , কিন্তু এই বছর………..”। আমি দেখতে পাই না বলেই ও চক্ষু দান করার সিদ্ধান্ত নেয় আর চক্ষু দান করতে গিয়ে আজ আমায় ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ওর চোখ দুটো এখনও বেঁচে আছে তোমার মধ্যে আর তাই শেষ বারের জন্য ওকে আমি এই উপহার দিতে চাই।

কেয়াকে bed এ shift করার পর আমি waiting room এ বসে আছি এমন সময় সামনের tv তে দেখলাম , আজ সকালে আসা অন্ধ ভদ্রলোকটি রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। তখন বুঝলাম শেষবারের মতো কথাটা বলার কারণ।

আর আমি নীরব স্রতার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম , এক ভালোবাসা আত্মহত্যা করে আরেকটা ভালোবাসাকে পূর্ণ জীবনদান করেছিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।