• Uncategorized
  • 0

|| অণুগল্প ১-বৈশাখে || বিশেষ সংখ্যায় দেবাঞ্জন মহাপাত্র

ঘুম ভাঙে খুব সকালে, অন্ধকারে ঢাকা থাকে তখনও, প্রতিদিন এর মতো সেদিনও ভোরে উঠে দেখি , নির্মলা পাশে শুয়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে , সারাদিন সংসারের খাটাখাটনির পর এই রাতটুকু পায় সে দুচোখের পাতা এক করার । ঘরে ছেলে, বউ,বাচ্চা অনেকেই আছে , কিন্তু সংসার সামলাতে হয় সেই তাকেই। সেই কোন ছোট্টবেলায় আমি বউ করে নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। স্বামী কি জিনিস , শশুর , শাশুড়ি, সংসার এইসব কিছু তার ওই ছোট মস্তিষ্কে ঢোকার মত বয়স তখনও হয়ে নি , তাই আমি আর ১০ জনের মতো ওই ছোট বয়সের উপর পূরুষালী ক্ষমতা প্রকাশ এর চেষ্টা করি নি , আমি ওকে মায়ের কাছেই শুতে দিতাম , আমি থাকতাম আলাদা। ওর যখন বয়স হলো ১৫ , তখন আমার বড় সন্তান জন্ম নিল , তার ৩ বছরের মধ্যে এক মেয়ে আর এক ছেলে , তার ২ বছরের মধ্যে আর এক মেয়ে। মোট আমার ৪ টে সন্তান। বড়ো ছেলে এখন আমার মতই চাষবাস আর যজমান বৃত্তি করেই দিন কাটায়। আর ছোট ছেলে কলকাতা থেকে পড়াশোনা করে একটা বড় অফিসে চাকরি করে , সপ্তাহে একদিন মাকে দেখতে আসে “মা কেমন আছ , জিজ্ঞাসা করেই চলে যায়”। তার আমার উপর রাগ কারণ তার পড়াশোনা সে নিজেই চালিয়েছে, আমি তাকে নাকি কিছুই দেই নি , সেই জন্য সে আমার সাথে কোনো কথা বলে না। ছোট বৌমা এখানেই থাকে , তার দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে, আমি খেয়াল রাখি নিজের মেয়ের মত করে । তবু কোনো বৌমাদের হাতের ভাত জোটে না ,ওই নাতি- নাতনীদের জন্মদিনে একবাটি মাংস ব্যাস ওই যা। প্রতিদিনের মত আমি একটা বিড়ি ধরিয়ে পায়খানা সেরে চলে এলাম।তারপর বসে বসে আরো দুটো বিড়ি খাবো চাল নিচু হয়ে যাওয়া বারান্দায়।তারপর ভোরের আলো ফুটবে , আমি যাবো বাজারে বিমলের দোকানে চা খেতে , ঠাকুর মশাই মানুষ বিমল কোনোদিনও টাকা নয়ে না , আমি ওর বাড়ি পুজো করি প্রতি মাসের পূর্ণিমাতে তাই আমিও কোনোদিন দক্ষিণা নেই না ওর থেকে। নির্মলা কে ডাক দিয়ে আমি চললাম বাজারে চা খেতে , যখন ফিরলাম তখন সূর্য মামা তার ঘুমকে কষ্ট করে ভাঙিয়ে সবে পূব আকাশে উঁকি মারছে।
সবজি , মাছ বাজার সেরে একেবারে এলাম বাড়িতে। এসে দেখি তখনও নির্মলা ওঠে নি , আমি হাক পারলাম কোনো সাড়া শব্দ নেই , আমি ভিতরে গিয়ে দেখি তখনও সে শুয়ে,আমি তাকে জোরে জোরে ডাক দেই, কি গো উঠবে না !!গরু গুলোকে মাঠে নিয়ে যেতে হবে , আমি বাজার সেরে চলে এলাম। চা করো নি এখনো? , মাঠে রুইতে লোক হবে তো আজ কে ৪ জনের রান্না বান্না আছে , কইগো ওঠো দেখি । আমি গায়ে হাত দিয়ে ঠেলা দিতে দেখি এক প্রাণহীন, শীতল দেহ পড়ে আছে । নাকের পাশে আংগুল নিয়ে যেতে দেখি , নিশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ আমি তাও জোরে ধাক্কা দিতে লাগলাম। কোনো সাড়া শব্দ আর করলো না।বাইরে বেরিয়ে বড়ো ছেলেকে ডাক দিলাম , তখনও সে ঘুমাচ্ছিল , দরজা ধাক্কা দিলাম ,
ওরে বড়ো খোকা ওঠ তোদের মা যে আর নেই , দেখি ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো বড়ো ছেলে , বৌমা , ছুটে গেলো তারা মায়ের ঘরে,দেখলো কেবল ঠান্ডা দেহটা বিছানায় পরে আছে , কান্নাকাটি জুড়ল দুজন মিলে। কিছুক্ষন পর বড়ো খোকা বেরিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো , বাবা কি করে হলো এইসব ?? আমি বললাম , রাতে তোর মা না বলেই চলে গেছে আমদের এই দুঃখের সংসার ছেড়ে, আমি কিছু জানি না রে বাবা কথা থেকে কি হয়ে গেল !!চোখের কোন থেকে জল ভেসে যাচ্ছে তখন , বড়ো ছেলে, ছোট ছেলে কে ফোন করে খবর দিল , মেয়েদের কেও ফোনে করলো পাড়ার কিছু লোকেও খবর দিল , আসলো ডোম দের বাড়ির ছেলেরাও । ছোট ছেলে মেয়ে দের আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়া গেলো , পোড়ানো হবে আমার বাস্তের এক কোনায় , এটাই এখনকার নিয়ম। আমি অতক্ষণ ঠাএ বসে ছিলাম বারান্দার এক কোনায়। যেনো আত্মা হীন এক মৃত মানুষ বসে আছে। স্নান করানো হলো নির্মলাকে, গায়ে হলুদ মাখানো হলো , সুগন্ধী দেওয়া হলো, পায়ে আলতা পরানো হলো । সিঁদুর দেওয়ার সময় পাড়ার এক জেঠিমা বললো দিনু, তুই পরিয়ে দে বাবা বৌমাকে শেষ বারের মত, আমায় হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো নাতনি আমার দেহ যেনো অসার। ওর মাথার ধরে আমায় বসিয়ে দিলো। দেখলাম নাকে তুলো , চোখের উপর তুলসী পাতা , সিঁদুর কৌটোটা ধরিয়ে দিল আমার হাতে , আমি একমুঠ সিঁদুর হাতে ওর কপালে পরিয়ে দিলাম। ওর শরীর স্পর্শে যেনো সম্বিত ফিরলো আমি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম ,ওরে তুই না বলে চলে গেলি, এই দুঃখের সংসারে আমায় একা ফেলে গেলি মাথা খুঁড়ে মরার জন্য। তুই ছাড়া আর কেই বা ছিল বল, আমর এখন কে পান সেজে দেবে ,ধুতি কে মাড়দিয়া কে গুছিয়ে রাখবে, রাতে আমায় বাতাস করে ঘুম পাড়াবে কে? কী ভাবে পারলি আমাকে একা রেখে শাঁখা- সিঁদুর নিয়ে সজ্ঞে পাড়ি দিতে , যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস , আমিও আসছি তোর পিছে পিছে তোকে ছাড়া এ সংসার আমায় মেনে নেবে নারে নির্মলা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।