• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় দেবেশ মজুমদার

আরেকবার জন্ম নিতে চাই এই বাংলায় শুধু রবি ঠাকুরের জন্য

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। অঝোড়ে বৃষ্টি পড়ছিল। সেই সঙ্গে অবিরাম মেঘের গর্জন। আমাদের বাড়ির টেপ রেকোর্ডারে বাজছিল, “বাদল ধারা হল সারা, বাজে বিদাই সুর/ গানের পালা শেষ করে দে, যাবি আনেক দূর…”। গানটার অর্থ না বুঝলেও বুঝতে পেরেছিলাম এই পরিবেশের উপযুক্ত একটা গানের সুর বাজছে। চেষ্টা করছিলাম গুণগুণ করে গাইতে। সেই সময় হঠৎই বাবার প্রবেশ। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা কার গান?’ বাবা উত্তর দিলেন, রবি ঠাকুরের।
তখন আমি প্রথমিক স্কুলে। স্কুলের বারান্দায় ‘প্রার্থনা’ হচ্ছিল।“জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!/ পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ/ বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ /তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে, /গাহে তব জয়গাথা”। মনের ভিতরে একটা কাঁপুনি অনুভব করছিলাম। সেদনই জেনেছিলাম গানটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কে লিখছে? স্যারেরা বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমাদের বাড়িতে একটা বইয়ের তাক ছিল, বাবা শখ করে বানিয়েছিল। অনেক বই সাজানো ছিল সেখানে। মাকে দেখতাম মাঝেমাঝেই অবসর সময়ে বই টেনে নিয়ে পরতেন। ‘কার বই মা?’ একই উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।অবাক হয়ে দেখলাম স্কুল থেকে দেওয়া নতুন সহজ পাঠ বইটাতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম লেখা! কে এই রবি ঠাকুর? বাবা বললেন, “একে চিনে রাখ। জীবনের যে কোনও অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার জন্য কাউকে পাশে পাও বা না পাও, ইনি তোমার পাশে সব সময় থাকবেন”।
সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন।বাংলা ক্লাসে ভাষা আয়ত্ব করার জন্য আমার ভরসা সেই রবিঠাকুর। আমার সুখ দুঃখ আনন্দ অনুভূতি সবেতেই আমি রবি ঠাকুরকে খুঁজে পাই। আমার সময় কাটে তার গান গেয়ে। আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, সকলের সঙ্গে সেতু তৈরি করেছেন এই রবি ঠাকুরই!
রবীন্দ্রনাথের একেকটা লেখার অর্থ আমরা একেক সময়ে, একেক বয়সে একেক রকমভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ছোটবেলায় বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারি তার একটা বাক্য কতগুলো ভিন্ন অর্থ মেলে ধরতে পারে। যেমন, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকলখানে’ বা ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’ কিংবা ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে…’।
এখন গীতবিতান খুলে বসলে মনে হয়, যেন আমার অনুভূতিগুলোকেই রবীন্দ্রনাথ ভাষা দিয়েছেন। হয়তো আমারই জন্যই লেখা ওঁর গান। মা-কে এই কথাটা বলার পর জানতে পারলাম, এমন অনুভূতি আমার একার নয়, অনেকেরই হয়। গ্রীষ্মের পর প্রথম বৃষ্টির আনন্দ হোক কিংবা স্কুলের কোন বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া-সব কিছুই মেলানো যায় রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোন গানের সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের ভাবতে শেখায়। ‘দুই বিঘা জমি’ বা ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় নিজেদের প্রতিফলন দেখে অধিকাংশ সময়ই লজ্জিত হই। বিসর্জন-এ ‘এত রক্ত কেন’ পড়ে অদ্ভুত কষ্ট ছেয়ে যায় মনের মধ্যে।
ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গল্প পড়েছিলাম, ‘সুয়োরাণীর সাধ’। গল্পের শেষে সুয়োরাণী তাঁর সখীকে দুয়োরাণী সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন, যা আমার খুব ভালো লাগে। “ওঁর বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল, আমার সোনার বাঁশি কেবল বয়েই বেড়ালেম, আগলে রাখলেম, বাজাতে পারলেম না”।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রভাবিত করেছেন তার ব্যক্তিত্ব দিয়েও। স্বদেশ পর্যায়ের গান শুনতে শুনতে বুঝতে পারি ওনার নিঃশব্দ বিদ্রোহের কথা। জেনেছি ‘ নাইট’ উপাধি ত্যাগের কথা। জীবনের নানা সময়ে বহু প্রিয়জনকে হারিয়েও যে তিনি মনের জোর হারাননি, তা থেকে আমরা তাঁর মানসিক দৃঢ়তার কথা জানতে পারি।
রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজের গান-কবিতায় বলে গেছেন, ঘটা করে উদযাপন না করে তাঁকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিলেই তিনি বেশি খুশি হবেন। আমাদের বাড়িতে কখনও ২৫শে বৈশাখ বা ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা পরানো হয় না। শুধু গান আর কবিতার মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করি। বছরে দু’দিন তাঁকে আলাদাভাবে সাজিয়ে বাকি দিনগুলো হেলায় ফেলে রাখার অর্থ হয় না।
বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছেন, অনুভূতি ভাগ করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে সবসময় আমার পাশে পাব। এখন বুঝি কততা সত্যি ছিল বাবার কথাটা। এখন যেদিন খুব মন খারাপ হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। মন ভালো হয়ে যায়।
এক অধ্যাপক বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর এক মহান কীর্তি। বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে মনে রাখতে হবে তার গানে। কথাগুলিযে কতখানি প্রাসঙ্গিক তা অনুভব করতে পারি যখন দেখি তার রচনা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে আনন্দ দেয়। আমাদের বিভিন্ন অনুভূতিতে তার গানকেই আমরা পাথেও করতে পারি। সুখকে যেমন অনুভব করতে পারি তেমনি দুঃখকেও ভুলে যেতে পারি তার গানে। ছোটবেলায় শুরু করে আজও শেষ করতে পারি নি রবি ঠাকুরের সৃষ্টীকর্মকে। একটা জীবন যেথেষ্ট নয় তার সৃষ্টিকে বুঝতে। তাই আরেকবার জন্ম নিতে চাই এই বাংলায় শুধু রবি ঠাকুরের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ-রবিঠাকুর জাতীয় জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনে বারবারই আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন, দেন। কারণ, তিনি বটবৃক্ষ। আর বটবৃক্ষের তলে সবাই-ই তো ছায়া পায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।