ছোটগল্পে দেবদাস কুণ্ডু

সংগীত

অনেক দিন ধরে মনের ভিতর উঁকি দিচ্ছিল একটা অস্বস্তি। সেটা এখন ডালপালা মেলে লাভ করেছে বিস্তার। ক্রমশ অসহ্য লাগছে মনীষার কাছে। কি করে একটা মানুষ এত শীতল হতে পারে? এতো উদাসীন থাকতে পারে? একদিনও প্রশ্ন করলো না, মনীষা যে ভদ্রলোক তোমাকে রোজ গাড়ি করে অফিস থেকে বাড়ি পৌঁছে দেয়, কখনো কখনো বাড়িতে আসে, কফি খায়, আমাদের বেড রুমে ঢুকে গল্প করে, সেই লোকটি কে? তোমার সংগে সেই মানুষটির কি সম্পর্ক? কোনদিন একবারের জন্যও এই সব প্রসঙ্গ তোলে নি উদার।
উদার একজন শিল্পী। গ্লাস পেইটিং করে। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় তার কাজ এজেন্টরা
নিয়ে যায়। প্রচুর অর্থ যে তাতে পায়, তা কিন্তু নয়। অর্থের প্রতিও ওর একটা উদাসীনতা আছে।
একটা শিল্প প্রদর্শনীতে উদারের সংগে তার আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম। প্রেম থেকে বিয়ে। উদারের শারিরীক চাহিদা স্বল্প। কিন্তু তার ভিতর অনবরত একটা আগুন জ্বলে। সেই আগুন নিয়ে সে খেলা করে রাজীব সিংনহার সংগে। উদার কি বোঝে না? কোনদিন তো বললো না—তোমারা কি করো? ডাইনিং বসেই তো গল্প করতে পারো। এ যদি অন্য পুরুষ হতো, তবে প্রথম দিকে অশান্তি। পরে তীব্র ঝগড়া। শেষে ডিভোর্স। সে সব কিছু না। সাপের রক্তের মতো শীতল উদার। আর এটাই তাকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলেছে। সে উদারের এই অনিহা সহ্য করতে পারছে না।
তবে কি উদার তাকে এখন ভালোবাসে না?
সেটাই বা সে বলে কি করে? কিছু দিন আগে হয়েছিল জ্বর সর্দি কাশি। ওষুধে কমছিল না। উদারই ডাক্তারের কথা মতো সোয়াব টেস্ট করায়। ধরা পড়ল করোনা। হোম আইসোলেশনে থাকলো। তখন উদার কি সেবাটাই না করেছে। মনীষা বলেছিল
–তুমি এতো ক্লোজে এসো না।
–কি হবে? করোনা? হোক। ভালো তো।
তবু বুঝবো তোমার কাছ থেকে একটা কিছু তো
পেলাম।
আশ্চর্য মানুষ তো উদার! এরই নাম কি নি:শব্দ প্রেম?
রাজীব সিংনহাকে ফোন করেছিলো মনীষা। করোনা শুনে আর কোন যোগযোগ
রাখেনি। তাহলে উদার কি করে সব ভয় উপেক্ষা করে তার কাছে এলো? যারা নি:শব্দে শিল্পকর্ম করে, তাদের হৃদয়ে বুঝি কারো জন্য নি:শব্দে প্রেম বেঁচে থাকে! শুধু খুঁজতে হয়। অনুভব করতে হয়। ক’জন এমন ভাবে ভালোবাসাকে মহার্ঘ করতে পারে?
প্রবল জ্বরের মধ্যে মনীষা অনুভব করেছিলো
উদার শীতল হাত দিয়ে তাকে আদর করছে। সেই আদর রাজীবের ক্ষুধার্ত আদরের মতো নয়। বুদ্ধের চোখের মতো শান্ত। উদারের ভালোবাসার এতো শক্তি যে
করোনার রক্ত চোখকে পরাস্ত করতে পারে?
পেরেছিল। সত্যি পেরেছিল। আবার যখন সোয়াব টেস্ট করা হলো, তখন দেখা গেল তার সামান্য করোনা আছে কিন্তু উদার করোনা মুক্ত।
একদিন রাতে উদারের স্টুডিও ঘরে ঢুকলো মনীষা। বলল-একটা কথা বলার ছিল।
–তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো মনীষা।
মনীষা বসলো।
–বলো কি বলতে এসেছো?
–আমার ওপর তোমার ঘৃনা হয় না?
–কেন? ঘৃনা হবে কেন? উদারের গলায় বিস্ময় ।
—রাগ হয় না?
–রাগই বা হতে যাবে কেন?
–এই যে আমি রাজীবের সংগে মেলামেশা করি?
—তাতে কি হলো? তুমি যে কোন মানুষের সংগে মেলামেশা করতে পারো।
—আমি সেই মেলামেশার কথা বলছি না।
–তাহলে কি বলতে চাইছো?
–আমি তো রাজীবকে শরীর দিয়েছি।
এই কথায় সহসা জবাব দিল না উদার। কিছু সময় চুপ করে অর্ধ সমাপ্ত কাজটির দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–কি হলো? চুপ কেন? উতলা হলো মনীষা।
–কি বলবো? আমি তো শরীরে বিশ্বাসী নই। আমি তোমার শরীর ভালবাসিনি। শরীর তো একদিন পুড়ে ছাই হবে, তখন কি আমার ভালোবাসা মরে যাবে? তুমি আনন্দ পেয়েছ, শরীর দিয়েছো। মানুষ যে কাজে আনন্দ পায়, সেই কাজই করে।
–কিন্তু এটা তো অন্যায়।
–আমি ন্যায় অন্যায় বুঝি না। আমি বুঝি আনন্দ। যেমন আমি এই কাজ করে আনন্দ পাই। তাই করি। আর একটা কথা ন্যায় অন্যায়ের সংজ্ঞা ভেরিয়েশন করে।
মনীষা কিছু বলতে পারে না। যত রাত বাড়ছে উদার ততো অন্য মানুষ হয়ে উঠছে। তার চিন্তা ভাবনার বাইরের মানুষ উদার।
–আরো একটা কথা বলবো তোমায় মনীষা, আমি মনে করি ভালোবাসা একটা সংগীত। সংগীতের কোনদিন মৃত্যু হয় না বুঝলে!
মনীষা অনেক সময় ধরে নিজকে সংযত রেখেছিল, আর পারলো না। উদারের শেষ কথাটা তার ভিতর নিয়ন্ত্রণের বাঁধ ভেঙে দিল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল উদারের বুকে।
উদার কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে হাসছে। প্রথমে নি:শব্দে। তারপর শব্দ করে।
তার স্টুডিও ঘরটা গম গম করছে। তারপর সেই সশব্দ হাসি জানালা দিয়ে বাইরে গিয়ে মিশে গেল আকাশে বাতাসে।
রাতের পৃথিবী শুনলো, জগৎ জুরে এক ভালোবাসার সংগীত বাঁজছে। সেই সংগীতের ধ্বনি সমুদ্রের ঢেউ হয়ে নাচছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।