সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবদাস কুণ্ডু (পর্ব – ১০)

লড়াইয়ের মিছিল

পর্ব – ১০

হন হন করে হাঁটছে বিপুল। আজ দেরি হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙে নি সকালে। কাল রাতে অনেক সময় ধরে পড়াশুনা করেছে। যখন চোখ আর শরীর প্ররিশমের ভার নিতে পারছে না তখন দুটো চোখ প্রজাপতির ডানার মতো গুটিয়ে আসছিল। সে টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। মাঝ রাতে রমলা দেবী উঠে দেখে ছেলে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তিনি ডেকে তোলেন, ‘কি রে বাবু এখানে কেন ঘুমাচ্ছিস। যা ঘরে গিয়ে শো। ক্লান্ত শরীর টেনে ঘুম চোখে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ভাই বিমলের পাশে শুয়ে পড়ে ছিল। সেই ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়। ধরমর করে উঠে পড়লো। মনের ভিতর একটা ক্ষিপ্ততা জেগে উঠলো। বলল, ‘আমায় ডাকবে তো। সাতটা থেকে ন টা আমার দুটো টিউশনি। তারপর কোচিং এ ক্লাশ। দুপুরে যেতে হবে এক্সচেঞ্জ। তারপর ছোটো হাওড়া নিজের ইংলিশ ক্লাস। এম এ দিচ্ছে সে প্রাইভেটূ। ছ মাস পর পরীক্ষা। প্রিপারেশন নেবার সময় পাচ্ছে না। বলল, ‘এই তোমার জন্য আজ সব ভুন্ডল হয়ে গেল।
রমলা দেবী কলঘরের ভিতর বাসন মাজছিলেন। বললেন, ‘আমি কি করলাম?
‘তুমি কি করলে? আমাকে একবার ডাকোনি কেন?কোনদিন এতো বেলা অবধি ঘুমাই আমি? আমি কি রাজার ছেলে? ঘুম থেকে উঠবো বেলা দশটায়।
‘অত রাত জেগে পড়ে ঘুমাতে গেলি তাই আর ডাকি নি।
‘না ডেকে আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছ।
‘সকাল বেলা এসব কি বলেছিস তুই?
‘ঠিকই বলছি। সারাটা দিনে এক মূহুর্তের বিশ্রাম পাই না। আমি যেন একটা কলের পুতুল? সকালে দম দিলাম আর রাত বারোটা পর্যন্ত সেই দমে পুতুল ছুটবে? ইচ্ছে হলে দু দন্ড বিশ্রাম নিতে পারবো না। কেন?
‘এসব আমাকে বলেছিস কেন বাবু? আমি কি করলাম?
‘তুমি কি করলে? তুমিই যতো নষ্টের গোড়া। এতো গুলো সন্তানের জন্ম দেবার তোমার কি দরকার ছিল? দুটো ছেলে একটা মেয়ে নিয়ে তোমার কি মন ভরছিল না? নাকি ঘর ভরছিল না? তোমারা রাজপ্রাসাদে থাকো নাকি? এই বস্তির দখলি ঘরে আশ্রয় পেয়েছিলে বলে। না হলে ও দেশ থেকে এসে পথে পথে ঘুরতে হতো।
‘তোর বাবা তো সত্যি পথে পথে ঘুরছিলেন। জায়গা টা দখল করতে লড়াই করতে হয়েছে। কেউ দয়া করে দেয় নি। কেউ যাতে আবার দখল করে না নেয় তার জন্য তোর বাবাকে রাতের পর জাগতে হয়েছে।
‘আমাকে যে কত রাত জাগতে হবে কেজানে?
‘’কেন রাত জাগবি? । তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বি।
‘সেই ভাগ্য করে এসেছি কি? ইস কতটা কেটে গেল! দাড়ি কাটতে কাটতে কথা বলছিল বিপুল। ব্লেড গেঁথে গেছে ডান গালে। এখন ফিটকারি চেপে ধরে থাকো। এমনই দেরি হয়ে গেছে। আরো দেরি হবে আর কি! বলল, ‘তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার কথা বলছো, মাস শেষ হলেই তো হাত পাতবে।
‘তা কি করবো বল? রমলা দেবী কলঘরের কাজ শেষ করে ঘরে এসে বলেন, ‘তুই বড় ভাই। ছোটো ভাই বোনদের দেখবি না তো কে দেখবে? জানিস তো তোর বাবা হুঁশিয়ারি কারখানায় কাজ করে। কতো আর পায়? তা দিয়ে এতো গুলো পেট চলে?
‘তখন মনে ছিলো না এসব? এ বাজারে কেউ ন টা সন্তানের জন্ম দেয়?
মুখ চোখ ধুয়ে জামা প্যান্ট পড়ে চা নিয়ে বসল বিপুল। একটু আয়েস করে যে চা খাবে তার সুযোগ টুকু নেই। শরবতের মতো চা খাচ্ছে। একটা ভাইয়ের পর আটটা ভাইবোন দেখা সম্ভব? বলে, ‘আমি আর কতো রক্ত তুলবো মুখে বলতে পারো? এতো রাক্ষসের খিদে। হা করে আছে আটটা মুখ। আমি কটা মুখকে খাবার দেবো?
‘সব বুঝলাম। এখন কি করবি বল? ‘
ডাইরি ব্যাগে ভরে বিপুল বলে. ‘কালপিঠ হলো দিনেশ পাল।
এতো গুলো সন্তানের জন্ম দিয়ে একদন তো কেটে পড়বে। এই খিদের পাহাড় আমার ঘারে এসে পড়বে।
‘সকালবেলা এসব কি বলেছিস দাদা? বিশাখা বাথরুম থেকে বের হয়ে কথাটা বলল।
‘তুই চুপ কর। ক টাকা দিস সংসারে? আমার পার্শটা গেল কোথায় আবার? ‘বিইয়ের সেলফে, ড্র্যায়ার, প্যান্টের পকেট। খুঁজে পেল না। হঠাৎ চোখে পড়ল পায়ের কাছে পড়ে আছে। তুলে পিছনের পকেটে ভরে দরজার কাছে এলো। জুতো পড়ল।
বিশাখা বলল, ‘তুই একা টাকা দিস না। আমরা দু বোনও টাকা দেই। না হয় তুই বেশি দিস। তার জন্য বাবাকে অসন্মান করবি?
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল বিপুল, ‘তোরা লোকটার মূর্তি বানিয়ে পুজো কর। আমি চললাম।
‘দাঁড়া দাঁডা।
‘আমার দাঁড়াবার সময় নেই। লোকটা একটা আদিম বর্বর অসভ্য।
‘তুই বাবাকে এসব কথা বলতে পারিস না। ভাগ্য ভালো লোকটা ঘরে নেই এখন। শুনলে কি কষ্ট পেতো
‘তার চেয়ে বেশি কষ্ট আমি পাচ্ছি।
শোন বাবার কিন্তু বড় ব্যবসা ছিল। আজ তা নেই। তার জন্য—
‘দেখ তোদের যখন বাবার জন্য এতো দরদ লোকটাকে দুবেলা পূজো কর।
‘দরকার হলে তাই করবো। তিনি আমাদের বাবা।
‘শোন, এই দাদা ঘোড়ার মতো ছোটে। একদিন দখবি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে মরে আছে।
‘ছি দাদা। আজকে তোর কি হয়েছে। কেন এসব কথা বলছি? ।
বস্তির পরিবেশ তার এতো টুকু ভালো লাগে না। এই তো একটা কলে মৌচাকের মতো লোক ভন ভন করছে। ঝগড়া করছে। মেয়ে বউ অদ্ধ নগ্ন হয়ে চান করছে। চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই আছে। সন্ধা বেলা মাতালের উৎপাত। গালাগালি। একটা নরক যেন। এর থেকে কবে মুক্তি হবে, সে জানে না।
এখন রীতাকে পড়াতে হবে। মেয়ে টার মাথায় কিছুই নেই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে টিউশনটা ছেড়ে দেবে। কিন্তু সপ্তাহে দুটো দিন পড়িয়ে হাজার টাকা। কে দেবে এই টাকা? সেদিন ওয়াস ওয়ার্ডের লুসি কবিতাটা বুঝিয়ে দিয়েছে, তবু বুঝতে পারে নি। আজ আবার বোঝাতে হবে। কবিতাটা তার ভালো লাগে। একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে যাচ্ছে। পথে বার বার ঘোড়া থেমে যাচ্ছে। প্রকৃতির রুপ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে পড়ছে। প্রেমিকার কাছে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কি অপূর্ব কবিতা। তার জীবনে এই রকম কোন প্রেমিকা অপেক্ষা করবে? ভাবার সময় নেই।
এখন হন হন করে হাঁটছে বিপুল। বুঝতে পারছে চোখ দুটো ভিজে আসছে। কার জন্য?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।