Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পবাজে অঞ্জলি দে

maro news
গল্পবাজে অঞ্জলি দে

তিন পুরুষের সাইকেলটি

লীলাবতী নন্দী। আমার ঠাকুমা। তাঁর বাবা কলকাতার মেটিয়াবুরুজ নিবাসী শ্রী মম্মত কুন্ডু। দু মেয়ে নিয়ে সংসারী। ছোটটির বয়স তিন ও বড়টির বয়স ছয়, তখন স্বামী ও দু মেয়েকে রেখে মা স্বর্গ লাভ করলেন। বাবা নেশা করে। রেশ খেলে। সরকারী, টাকা ছাপার অফিসে কাজ করে। মেজো কাকীমার কাছে মা মরা মেয়ে দুটি বড় হয়। বারো বছর বয়সে বড় মেয়ের ও চোদ্দ বছর বয়সে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল, মেজো কাকা। ছোট মেয়েটির সঙ্গে যাঁর বিয়ে হল তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর একটি দশ বছরের মেয়ে আছে। একে জন্ম দেওয়ার সময়ই সে মারা যায়। শ্রী মানিক চন্দ্র নন্দীর দ্বিতীয় পক্ষের পত্নী হয়ে হুগলীর চৈতন্যবাটী গ্রামে এলো। শ্বাশুড়ী খুব অত্যাচার করে। পতি একমাস বাদ বাদ বাড়ি আসে। সে কলকাতার বৌবাজারের একটি কারখানার সুপারভাইজার। সেখানেই কোম্পানির দেওয়া বাড়িতে থাকে। পাঁচ বছর পর লীলাবতী একটি পুত্র সন্তানের জননী হল। দাদামশাই বড় খুশি হল। সে তার মেটিয়াবুরুজের বিরাট বাড়িটি নাতীর নামে উইল করতে চাইল। কিন্তু জামাই তা নিল না। তখন সে বাড়িটি দাদু তার মেজো কাকাকে দিতে চাইল। কিন্তু সেও নিল না। তখন সে তার ছোট ভাইকে দান করল। নাতী শ্রী দেবী প্রসাদ নন্দী দাদুর বাড়ি যায়। খুব আদোরের নাতী। বিপত্নীক নিজে রেঁধে খায়। মেয়ে এলে সে-ই রাঁধে। দাদুর প্রিয় একটি হারকিওলিক্স সাইকেল ছিল। সে সেটি চালাতো। কয়েক বছর পর দাদু মৃত্যু শয্যায়। মেয়ে, জামাই, নাতী এলো। মরার আগে নাতীর হাতের জল খেল আর বলল, " আমার সাইকেল ও কেরোসিনের পিতলের স্টোভটি তুই নিস! তুই বড় হয়ে চালাস! আর তোর বউ এলে সে যেন এই স্টোভটায় রাঁধে!" চোখ বুঝল দাদু। তারা নিজেদের বাড়ি এলো। সঙ্গে ও দুটি জিনিস। দেখতে দেখতে দেখতে অনেক বছর পেরিয়ে গেলো। দেবী ওই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায় ও আসে। তারা ছয় ভাই, বোন। তিন ভাই, ওরা ওই একটা সাইকেলই ব্যবহার করে। দেবী চাকরী পেল। ওই সাইকেল চালিয়ে সে অফিসে যায় ও আসে। দেবীর বিয়ে হল। কলকাতার হাতী বাগানের মেয়ের সঙ্গে। সে সংসারের হাল ধরল। দেবীর বাবা কয়েক বছর পর রিটায়ার্ড করল। সেও গ্রামে এসে থাকল। ভরা পরিবার। দেখতে দেখতে দেখতে দেবী দু মেয়ে ও এক ছেলের বাবা হল। দাদা ভায়েদের লেখাপড়া শেখাল। বোনদের বিয়ে দিল। ভায়েরা চাকরী নিয়ে বিদেশে চলে গেল। সেখানে ওরা বিয়ে করে থাকে। মাঝে মধ্যে আসে। দেবীর বড় মেয়ে, তারপর ছেলে ও তারপর ছোট মেয়ে। তিনজন লেখাপড়ায় খুব ভালো। দেবীর সাইকেলটি সে তার ছেলেকে দিয়ে দিল। ওর ছেলে শ্রী আশিস নন্দী সেটি চালিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। দেবীর বড় ও ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে ওরা বিদেশে চলে গেল। ছেলেটির বয়স যখন ত্রিশ বছর তখন ও গলায় দড়ি দিয়ে নিজের পড়ার ঘরে ঝুলে পরল। দেবী তখনও অফিসে জব করে। তার স্ত্রী শ্রীমতী সবিতা নন্দী তখন থেকে অর্ধ পাগলিনী। দেবী অর্ধ পাগল। তবুও আশিসের মৃত্যুর সাত বছর পর সে অফিসে কাজ করে, মৃত্যুর আগের মাস পর্যন্ত এবং এক মাস সে শয্যাশায়ী রইল। কারণ তার মূত্রাঙ্গে ক্যান্সার হওয়ায় শ্রীরামপুরের এক নার্সিং হোমে ভর্তি ছিল। তারপর সে মারা গেল। সবিতা দেবীর মৃত্যুর তিন বছর অর্থাৎ আশিসের মৃত্যুর দশ বছর পর ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হল। সেও ওই একই নার্সিং হোমে ভর্তি হল, ভর্তি করল ওদের ছোট মেয়ে ও জামাই। কারণ তারা তখন বিদেশ থেকে চলে আসে শেওড়াফুলীতে বাড়ি করে আছে। এক মাস পর সে মারা গেল। সাইকেলটি আশিসের গলায় দড়ি দেওয়া ঘরে আজও রাখা আছে। ঠিক যেখানে ও দড়ি বেঁধেছিল সেখানেই দড়ি বেঁধে ওই সাইকেলটিকেও ঝুলিয়ে রেখেছিল ওর বাবা। আর ওর মাও শেষ পর্যন্ত ওভাবেই সাইকেলটিকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখল। সাইকেল।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register