Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

|| হিগস বোসন ও পিটার হিগস || জন্মদিনের স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

maro news
|| হিগস বোসন ও পিটার হিগস || জন্মদিনের স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

হিগস বোসন ও পিটার হিগস: আজ বিজ্ঞানীর জন্মদিন

কণাপদার্থবিদ‍্যার জগতে বোসন বলতে সেইসব অতিপারমাণবিক কণাকে বোঝায়, যার স্পিন কোয়ান্টাম নম্বর একটা পূর্ণসংখ্যা, যেমন শূন‍্য, এক, দুই,.... ইত্যাদি। আরেক ধরনের অতিপারমাণবিক কণা আছে, তাদের স্পিন হল ১/২, ৩/২, ৫/২, এরকম। এগুলিকে বলে ফের্মিয়ন। বাস্তব জগতে যে সমস্ত অতিপারমাণবিক কণা পাওয়া যায়, তারা হল এই বোসন, নয়তো ফের্মিয়ন। বোসন নামটা দিয়েছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক। ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু সঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে নিয়ে এ ধরনের কণাগুলিকে চিনিয়েছিলেন, যারা বোস-আইনস্টাইন স্ট‍্যাটিসটিকস মেনে চলে। ডিরাক সত‍্যেন্দ্রনাথ বসুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই পর্যায়ের অতিপারমাণবিক কণাগুলিকে বোসন বললেন। কণাপদার্থবিদ‍্যার জগতে যেসব কণাগুলি লেপটন বা কোয়ার্কের মতো জিনিস তৈরি করে, তাদেরকে ফের্মিয়ন বলে। যে সমস্ত কণা ফের্মি-ডিরাক স্ট‍্যাটিসটিকস মেনে চলে, এবং তার সঙ্গে পাউলি এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে, তাদেরকে ফের্মিয়ন বলে। এই নামটিও ডিরাকের দেওয়া। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি, যিনি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এবং নিউক্লিয়ার যুগের স্থপতি হিসাবে পরিচিত, তাঁর স্মরণে প্রোটন নিউট্রন ইত্যাদি কম্পোজিট কণা, এবং ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো ইত‍্যাদি প্রাথমিক কণাকে ফের্মিয়ন বলা হয়। লেপটন ছয় রকমের। ইলেকট্রন, ইলেকট্রো নিউট্রিনো, মিউঅন, মিউঅন নিউট্রিনো, তাউ, তাউ নিউট্রিনো। কোয়ার্ক হল এক ধরনের প্রাথমিক কণা, যা একসাথে জুড়ে হ‍্যাড্রন তৈরি করে। আর সেই হ‍্যাড্রন দিয়েই প্রোটন আর নিউট্রন তৈরি হয়। কোয়ার্ক ছয় রকমের। আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম আর টপ। আর বোসন প্রধানতঃ পাঁচ রকম। তার দুটি গোষ্ঠী আছে, স্কেলার বোসন ও ভেক্টর বোসন।শূন‍্য স্পিন যুক্ত হিগস বোসন হল একটি স্কেলার বোসন। ভেক্টর বোসনেরা চারটি। এই চারটি বোসন ফোর্স বহন করে। অন‍্যবিধ কণায় এই ভেক্টর বোসনেরা ফোর্স তৈরি করে। এদেরকে গজ বোসন‌ও বলা হয়। এরা হল ফোটন, গ্লুঅন, এবং ডব্লিউ ও জেড কণা। এর মধ্যে ফোটন তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের ফোর্স বহন করে। গ্লুঅন স্ট্রং ফোর্স বহন করে। জেড কণা এবং ডব্লিউ কণা দুটোই উইক ফোর্স বহন করে। তবে, জেড কণা হল তড়িৎ নিরপেক্ষ। ডব্লিউ কণাদের ম‍্যাগনেটিক মোমেন্ট আছে এবং তড়িৎ ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক দু ধরনের চার্জ আছে। পিটার হিগস (২৯ মে, ১৯২৯ - ) একজন তিরানব্ব‌ই বৎসর বয়স্ক বিজ্ঞানী, আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁর নামেই হিগস বোসনের নাম হয়েছে। পিটার হিগস ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আরো পাঁচজন বিজ্ঞানী, রবার্ট ব্রাউট, ফ্রাঙ্কয়েস এঙ্গলার্ট, জেলান্ট গুরালনিক, সি রিচার্ড হাগেন এবং টম ক্লিবল, এঁরা সকলে মিলে তিনটি টিম তৈরি করে, কেমন করে ভরের সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে আলোচনা করতে করতে হিগস মেকানিজম গড়ে তোলেন। এবং হিগস ফিল্ড এবং হিগস বোসন সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেন। এঁরা ছয়জন সকলে মিলে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জে জে সাকুরাই পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর এঁদের মধ‍্যে পিটার হিগস এবং এঙ্গলার্ট যৌথভাবে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আজ পিটার হিগসের জন্মদিন উপলক্ষে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করা দরকার। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রাথমিক কণায় বিশেষতঃ, ডব্লিউ এবং জেড বোসনে কিভাবে ভরের সঞ্চার হয়, তা নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন। এই সূত্রে একটি নতুন কণার নাম দেওয়া হয় হিগস বোসন। কিন্তু ষাটের দশকে এই তাত্ত্বিক ধারণাকে পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তব জগতে পাওয়া যায় কি না, তা যাচাই করে দেখা কণাপদার্থবিদ‍দের একটা বিরাট লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সূত্রে সার্ন (CERN) এর কথা বলা দরকার। সার্ন একটি অতিরাষ্ট্রিক সংস্থা। ইজরায়েল সহ মোট তেইশটি সদস্য দেশ নিয়ে এরা পৃথিবীর বৃহত্তম কণাপদার্থবিদ‍্যার গবেষণাগারটি পরিচালনা করেন। সার্ন এর মূল কেন্দ্র হল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এবং এই শহরটি ফ্রান্সের সীমান্তের একেবারে কাছে। আজ থেকে আটষট্টি বছর আগে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে সার্ন গঠিত হয়েছে। এদের‌ই উদ‍্যোগে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের চার জুলাই হিগস বোসন আবিষ্কার করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এই সূত্রে এল‌এইচ‌সি, বা লার্জ হ‍্যাড্রন কোলাইডার নিয়ে কথা বলা উচিত। এল‌এইচ‌সি হল জেনেভাতে ফ্রান্স সুইজারল্যান্ড সীমান্তে মাটির ১৭৫ মিটার নিচে, সাতাশ কিলোমিটার ব‍্যাপী একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তার ভিতরে অতিপারমাণবিক কণার ধাক্কা ঘটিয়ে কণাপদার্থবিদ‍্যা সম্পর্কে নতুন নতুন ত‌থ‍্য সংগ্রহ করা। ২০১২ তে এল‌এইচ‌সি হিগস বোসনের আবিষ্কার ঘোষণার পরে ২০১৩ তে আরেকজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কয়েস ব‍্যারন এঙ্গলার্ট এর সঙ্গে হিগস যৌথ ভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। হিগস ইংল‍্যাণ্ডের এলস‌উইক জেলায় জন্মেছিলেন। এবং ব্রিস্টলে বড় হয়েছেন। সেখানে ১৯৪১- ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কডহ‍্যাম গ্রামার স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিটি অফ লণ্ডন স্কুলে গণিতে যথেষ্ট ব‍্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কিংস কলেজ লণ্ডনে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওই কলেজ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই কলেজ থেকেই তিনি মলিকুলার ফিজিক্স নিয়ে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট করার পর, ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরায় তিনি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে যোগদান করেন। এবং শেষপর্যন্ত ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর হয়েছিলেন। এই এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই পিটার হিগস কেমন করে অতিপারমাণবিক কণার মধ‍্যে ভরের সঞ্চার হয়, তা নিয়ে আগ্রহী হন। এমন একটি তত্ত্ব গড়ে ওঠে যা বলে, বিশ্বসৃষ্টির সূচনায় কণাগুলি ভরহীন ছিল। এবং সূচনার পর এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ‍্যে তারা ভর অর্জন করে। হিগসের গবেষণার বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে জাপানি গবেষক ইয়োইচিরো নাম্বু-র কথা মনে রাখা দরকার। নাম্বু ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ‍্যায় তাঁর অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সার্ন এর ফিজিক্স লেটার্স নামে জার্নালে হিগস একটি সন্দর্ভ প্রকাশ করেন। ১৯৬৪ তেই শেষের দিকে তিনি হিগস বোসনের সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে পূর্বোক্ত ফিজিক্স লেটার্স এ একটি সন্দর্ভ লিখে পাঠান। কিন্তু পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করতে চাননি। তখন ফিজিক‍্যাল রিভিউ লেটার নামে আরেকটি পত্রিকা তা প্রকাশ করেন। হিগস ঘোষিতভাবে একজন নাস্তিক ছিলেন। লিওন ম‍্যাক্স লেডারম‍্যান নামে একজন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী যিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি নিউট্রিনো বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। এই লেডারম‍্যান হিগস বোসনের নাম রেখেছিলেন গডড‍্যাম পার্টিকল, অর্থাৎ হতচ্ছাড়া কণা। কিন্তু প্রকাশকের ব‍্যবসায়িক বুদ্ধিতে ব‌ইটির নাম দাঁড়ায় দি গড পার্টিকল। ১৯৯৩ সালে ডেল পাবলিশিং এই ব‌ই প্রকাশ করলে হিগস বোসনের সাধারণ পরিচিতি দাঁড়ায় গড পার্টিকল অর্থাৎ ঈশ্বর কণা। যদিও এর স্রষ্টা পিটার হিগস একজন নাস্তিক।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register