Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্পিতা বোস (পর্ব - ৫)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্পিতা বোস (পর্ব - ৫)

বৃত্ত

দু'নম্বর পেশেন্টের চোখে জলের ধারা। বিড়বিড় করে আবোলতাবোল কথা বলে চলেছেন। রূপসা যোগসূত্র খোঁজার যতই চেষ্টা করে ততই হারিয়ে যায়। দু'নম্বর পেশেন্ট বলে চলেন, --মায়া পরীক্ষাটা ভালো করে দিস। তোকে কলেজে পড়তে হবে। চাকরি করতে হবে। চোখ ভিজে আসে রূপসারও। বাবাও তো স্বপ্ন দেখতেন রূপসাকে নিয়ে। এই পেশেন্টেরও হয়তো মায়া নামের কোনও মেয়ে ছিল। আজ যেমন রূপসা আর বাবা দু'জনে হারিয়ে গেছে একে অপরের থেকে ঠিক তেমনই দু'নম্বর পেশেন্ট আর তার মেয়ে হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির গোলকধাঁধায়। -তুমি এখানে? কল্পনাদির গলায় পিছনে ফেরে রূপসা। চোখ মুছে বলে, -- রুম নম্বর সেভেনে যাওয়ার আগে একটু ঘুরে যাই। ওনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ছিল। গলা বুজে আসে কান্নায়। কল্পনাদি মাথায় হাত রেখে বলেন, -- তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। মেসোমশাইকে যেন তাড়াতাড়ি খুঁজে পাও সেই প্রার্থনা করি। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। দু'জনকে অবাক করে দু'নম্বর পেশেন্ট বলে ওঠেন, - সব ঠিক হয়ে যাবে মায়া। কেঁদো না। চোখের জল ধরে রাখতে পারে না রূপসা। আজ এই প্রথম দু'নম্বর পেশেন্ট বর্তমান অতীতকে এক সুতোয় গেঁথে নিলেন যেন! হাসি ফুটে ওঠে দুজনের মুখে। হয়তো এক নতুন সফলতার আলো। এই ধরনের রোগীরা সাধারণত কেবল অতীতেই ফিরে যান। অতীত আর কল্পনা সমন্বয়ে এক অলীক জগতে বাস করেন। বর্তমান থেকে একটু একটু করে হারিয়ে একসময় বিস্মৃতির আঁধারে হারিয়ে যান। বর্তমানে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন বয়স্কদের পক্ষে কখনওই সম্ভব হয় না প্রায়। ডিমেনশিয়া এক অদ্ভুত রোগ। মানুষকে বিস্মৃতি আর কল্পনার জগতে হারিয়ে ফেলার এক অন্ধকার নাম। রোগীর স্বাভাবিক কাজ ও জীবনধারা বদলে যায়, বেড়ে যায় নির্ভরতা। কখনও হিংস্রতা, কখনও অসংলগ্ন কথাবার্তা, কখনও নীরবতা এমন বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে যাওয়াই পরিণতি। এই রোগের সম্পূর্ণ চিকিৎসা আজও আবিষ্কার হয়নি। এই স্মৃতিবিলুপ্তির রোগীদের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ থেকে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীদের সুস্থ করে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞান নানান গবেষণায়, নতুন নতুন ওষুধ, পারিপার্শ্বিক শারীরিক কার্যকলাপ, কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে সফল হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। এই 'আশ্রয়' রিহ‍্যাবে এই ধরণের বিভিন্ন রোগীকে নিয়ে ডাক্তার সাত‍্যকী সেন আর নার্সরা এক অসম লড়াই লড়ছেন। এখানের অধিকাংশ রোগীই আর কখনও স্মৃতি ফিরে পাবেন না সবাই জানে, তবুও বিভিন্ন চিকিৎসা এবং আনুষাঙ্গিক বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের মাধ্যমে রোগীদের ভালো রাখার চেষ্টা করে চলেছে। আবার সাময়িক স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা নিয়ে কিছু রোগী এসেছেন, যাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ‍্যায় হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন কেউ কেউ। আর এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়াটাই বোধহয় 'আশ্রয়' রিহ‍্যাবের আশার আলো। যদিও রোগের ধরন ভিন্ন ভিন্ন তবুও স্মৃতি বিস্মৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া এই রোগীদের নিয়ে এক অন্য জগৎ এখানে। তবে প্রায় সব রোগীই কমবেশি রূপসাকে চেনে, মত বিনিময় করে রূপসার সাথে। রূপসার সহজ সরল এবং রোগীদের সাথে আন্তরিক মেলামেশার জন্য ডাক্তার সাত‍্যকীও রূপসার ওপর বিশেষ ভরসা করে। আজ দু'নম্বর পেশেন্টের একটা সম্পূর্ণ সান্ত্বনা বাক‍্যে যেন আবারও আশার আলো দেখে রূপসা। ফাইলে সবটুকু লিখে রূপসা ঘড়ি দেখে। কল্পনাদির সাথে কিছু দরকারি কথা সেরে দু'নম্বর পেশেন্টের মাথায় হাত রাখে আবার। হাসিমুখে বলে, -- সব ঠিক হয়ে যাবে আমিও জানি। আপনি এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।

দু'নম্বর পেশেন্ট উত্তর দেন, -- মাঠে খুব জল জমেছে। আজ তো ফুটবল খেলা হবে না।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপসা। রুম থেকে বেরিয়ে ভাবে কত তাড়াতাড়ি দু'নম্বর পেশেন্ট ভুলে যেতে পারেন আগের মুহূর্ত। ঠিক এমন করেই যদি রূপসা ভুলে যেতে পারত নিজের অতীত। কিন্তু বাবার মতো সব ভুলে যেতে পারেনি রূপসা। ডিমেনশিয়া যদি বাবার বদলে রূপসার হতো বোধহয় ভালো হতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোতে থাকে। সাত নম্বর রুমে যাওয়ার আগে পুরোনো পেশেন্টদের একটু দেখে যাবে ঠিক করে। সবার সাথে দেখা করে। কারো কারো সাথে হাত নেড়ে ঈশারায় কথা বলে। কাউকে দু'কলি গান শুনিয়ে হাসিমুখে রুম নম্বর সাতের দিকে পা বাড়ায়। রুমে গিয়ে দাঁড়াতেই রূপসার পা দুটো যেন আটকে গেল। নড়াচড়ার যেন ক্ষমতা নেই।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register