Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গল্পতে নীল নক্ষত্র

maro news
গল্পতে নীল নক্ষত্র

ক্যাফেটেরিয়া

-বাবিন আমার খুব খিদে পেয়েছে .....

দুপুরে গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। এখন পাঁচটা বাজতে চললো , বনি এখনও না খেয়ে আছে ভাবতেই চোখের পাতাটা আমার অজান্তেই বেশ ভারী হয়ে গেল। এখন তো শুখা মরসুম, মেঘ বলেছে যাবো যাবো... তার এই বলাটাই সার। তার হাতে আর সময় কোথায়। তাই জল পড়ে না, পাতাও নড়ে না। পাগলা হাতির মাথার কথা না হয় বাদই দিলাম এখনকার মতো।

ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে সেই জানালাটার পাশে গিয়ে বসলাম। জানালাটার ওপাড়েই আমাদের সেই কৃষ্ণচূড়া , যার পাতায় পাতায় বসন্ত যাই যাই করেও এখনো চলে যেতে পারেনি হয়তো আমাদের কথা ভেবেই।

-বাবিন তুমি আমার পাশে এসে বসো।

-কেন এটাই তো বেশ ভালো। বনলতা সেনের মতো মুখোমুখি বসে কথা বলতে বলতে রায়তা দিয়ে চিকেন বিরিয়ানি খাওয়ার মজাটাই আলাদা। ঠিক বললাম না কিনা বল?

-না , আমি বলেছি তাই তুমি আমার পাশেই বসবে। অত কথার কি আছে। আমার ভাল্লাগে না....যত ঢঙ!

বনি কে যতই দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। এই সেই মেয়ে যে রাতের অন্ধকারে কুমীরের ভয় কে উপেক্ষা করে একদিন কালিন্দী নদী সাঁতরে চলে এসেছিল এপাড়ে স্বপ্নে আমার ডাক শুনে।

তার মা ঠায় দাঁড়িয়েছিল একা এক ভুঁইচাপা ফুলগাছের গায়ে হেলান দিয়ে। ভোর হতেই সেই মায়ের চোখ থেকে হারিয়ে গেল তার হারানিধি।

পেট বড় বালাই। মেয়ের কষ্টের টাকায় সেই মেয়ের বাবা, মা , ভাই এখনো দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পায়। অথচ সেই মেয়ের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বেঁচে থাকার লড়াইয়ের থেকে বড় প্রিয়জনদের বাঁচিয়ে রাখার কাজ।

বারবার মা কে জিজ্ঞেস করেছে বনি ' মা বলো না যা, তোমার সাথে কোনজন্মে বাবিনের কি কোন যোগসূত্র ছিল? না হলে আমিই বা খুঁজে পেলাম কি করে, আর প্রথম দেখাতেই ভিক্টোরিয়ার আঙিনায় বাবিনই বা আমাকে চিনতে পারলো কি করে। কোনদিন তো বাবিন আমাকে দেখেনি। সেই তো তার প্রথম দেখা।

দু'বছর পরেও বনি যখন আমার মুখে শুনলো প্রথম দিনের গোলাপী রঙের শাড়িতে তাকে গোলাপের মত সুন্দর লাগছিল তখন ওর চোখ দুটো আমার চোখে নিজেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল, আমার চোখে সেটা এড়িয়ে যেতে পারেনি। তখন কে জানতো এই গোলাপে এত কাঁটা আছে। মুখঝামটা খেতে হবেই ,না হলে রাজকন্যার নাকি ভাত হজম হয় না। তাই অগত্যা প্রায়ই কাঁটার খোঁচা খেতেই হয়। তবে এই কাঁটায় মহুয়া ফুলের মতো একটা ঝিমধরা নেশা আছে। না পেলে মন আনচান করে। মন বলে এ মরণ অমৃত সমান।

বনি একচামচ বিরিয়ানি আমার মুখে তুলে দিয়ে বললো ,'"খাও বাবিন, একটুখানি খাও। খুব ঝাল, তুমি তো একদম ঝাল খেতে পারো না। একটু রায়তা খাও, ভালো লাগবে। রায়তাটা হেব্বি হয়েছে। "

এই হলো আমার বনি। এটাই তার পরিচয়, লোকে বলে সিগনেচার।

ক্যাফেটেরিয়ার ওয়েটার নতুন এসেছে। আগে তাকে দেখিনি আমি। শান্তশিষ্ট একটি অল্প বয়সী মেয়ে। বনির থেকে অনেক ছোট হবে। মাথায় হালকা নীল রঙের ক্যাপ, গায়ে নেভি ব্লু রঙের ইউনিফর্ম, চোখে অনন্ত জিজ্ঞাসা। বনির মতো তার উপার্জনের দিকে পথ চেয়ে বসে আছে হয়তো বনির মতোই তার ও মা, বাবা । না হলে তো এই মেয়ের এখানে আসার সময় তো এখন নয়। ওখানে সবাই ওকে অ্যানি বলে ডাকছে। বাঙালি বলেই তো মনে হচ্ছে। হয়তো ওর নাম অনামিকা বা অনিন্দিতা হবে, ছোট করে ডাকতে গিয়ে অ্যানি হয়ে গেছে। ভালোই লাগছে শুনতে।

ক্যাফেটেরিয়াতে ভীড় বাড়ছে, কোন টেবিল এখন আর খালি নেই। ক্যাফেটেরিয়া হলো সেল্ফ সার্ভিস রেষ্টুরেন্ট। নিজের খাবারের প্লেট কাউন্টার থেকে নিজেকেই নিয়ে আসতে হয়।

যে যার মতো খাচ্ছে, গল্প করছে , বনি বিরিয়ানির ডিমটা পুরোটা একাই খেয়ে নিল। ডিম খেতে ও খুব ভালোবাসে। এক ডজন ডিম ওর ফ্রীজে সব সময় থাকে। যখন ইচ্ছে হবে তখনই ডিম দিয়ে একটা কিছু বানিয়ে খেয়ে নেবে। ডিমের পোচ ওর খুব প্রিয়। তাই বলে বিরিয়ানিতে কোথাও ডিমের পোচ দেওয়া হয় না, আরসালান থেকে শুরু করে আমিনীয়া সব জায়গায় বিরিয়ানির সাথে বয়েলড্ ডিম পাওয়া যায়।

-বাবিন একটু চিকেন খেয়ে দেখো , কি নরম হয়েছে বলে চামচে করে আমাকে খাইয়ে দিল।

বনির চোখে চোখ রেখে আমি ভাবছিলাম কতদিন পরে এইভাবে কেউ একজন আমাকে খাইয়ে দিলো। মায়ের মুখটা হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই একই খুশির ঝিলিক তড়িৎ প্রবাহের মতো বয়ে গেল আমার বুকের মাঝে।

কেমন করে হয়, কেনই বা ফিরে ফিরে আসে সেই সময় জানিনা । আমি না তাকিয়েও পরিস্কার বুঝতে পারছি অ্যানির চোখ শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হলো ও কিছু খুঁজে পেতে চাইছে। কি সেটা জানি না। হয়তো তাকে এখনো কেউ এইভাবে খাইয়ে দেয়, বা ও নিজে হয়তো এইভাবে কারোর মুখে খাবার তুলে দেয় বনির মতো। আমার মনে হলো বনির মধ্যে হয়তো ও নিজেই নিজেকে খুঁজে পেতে চাইছে।

বনি প্রায়ই বলে নীল নক্ষত্রের চোখে সব কিছু ধরা পড়ে যায়, কোন কিছুই এড়িয়ে যেতে পারে না।

খাওয়া শেষ করে বনি স্প্রাইটের বোতলটা খুলে এক ঢোক খেয়ে বলে উঠলো আহ্, কি দারুন।

- আমাকে একটু দিবি না বলতেই এমনটা হবে আমি কল্পনাই করতে পারিনি। বনির কথা শুনে অ্যানির চোখে মুখে হেমন্তের ভোরে একমুঠো রোদ্দুরের মত একচিলতে হাসি আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল সেই অচিনপুরের দেশে। যেখানে একজনের খুশিতে আরও একজন তার নিজের খুশিকে খুঁজে পায়।

বনি বলেছিল ," বয়স হয়ে গেলে আর এসব খেতে নেই"........

বনি আমার অসমবয়সী এক ছায়াপথ। কি করে তারে বলি বয়স শুধু একটি সংখ্যা মাত্র, মনের বয়স বাড়ে না রে বনি, সে চিরসবুজ।

ক্যাফেটেরিয়ার জানালার ওপাড়ে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল আমার কবিতার একটি স্তবকের কথা।

....."বন্ধু মানে, কৃষ্ণচূড়ার ডালে রঙিন বসন্ত,

.....বন্ধু মানে, প্রজাপতির ডানায় তার সেই শিরশিরানি খুশি।

.....বন্ধু মানে, মনের ক্যানভাসে তুলির ছোট্ট একটি আঁচড়।।

....... বন্ধু মানে, জীবনের সাথে জীবনের যোগে ঘেরা এক নতুন জীবন......

যার আর এক নাম অনন্য বা অনন্যা যাই হোক না কেন।।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register