Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

অণুগল্পে পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি

maro news
অণুগল্পে পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি

ছায়া

কুমায়ুনের পিণ্ডারি হিমবাহের পথে কাপকোটের থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে পড়ে লোহারক্ষেত। জেলা সদর আলমোড়া। সেই লোহারক্ষেতের চার কিলোমিটার আগে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের বাড়ি। শখ করে পাহাড়-প্রকৃতির মধ্যে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন তিনি। স্ত্রী আগেই মারা যান। ব্রিগেডিয়ার মারা যান বছর তিনেক আগে। তাঁর দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। কেউ বিয়ে করেনি। বড় ছেলে সরোজ গত বছর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মিলিটারির চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এখন এই বাড়িতে। দ্বিতীয় ভাই মনোজ করোনার কারণে বাড়িতে বসে এমডি’র থিসিস লিখছে। আলমোড়াতে ওর ডাক্তারির চেম্বার। বোনদের মধ্যে বড় মীনার বয়স পঁচিশ। কাপকোটে একটি ব্যাংকে কাজ করে। বাসে বাড়ি থেকে যাতায়াত করে। ছোট বোন রীণার বয়স কুড়ি। দেরাদুনে হোস্টেলে থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়ছে।

সবাই আজ বাড়িতে। বড়ভাই হঠাৎ স্ট্রোকে গতকাল মারা গেছে। খবর পেয়ে রীণা চলে এসেছে। মারা যাওয়ার আগের দিন রাতে সরোজের সঙ্গে মনোজের অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়। কারণ, কেউ জানে না।

বিশাল বাড়ি। প্রত্যেকের আলাদা ঘর। পরিচারক একটি নেপালী ছেলে। মা-বাবার আমল থেকেই আছে। সেই রান্না এবং ঘরের সব কাজ করে। রাত আটটা নাগাদ তিন ভাই-বোন মনোজের ঘরে বসে। গত সাতদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। পাহাড়ে এমন প্রায়ই হয়। অন্ধকার ঘরে আলো বলতে ঘরের একদিকের দেয়ালের কাছে একটি টেবিলে রাখা মোমবাতি। বিষণ্ণ মনে সবাই চুপচাপ বসে আছে। এমন সময় মনোজ বলে উঠলো, “দেয়ালে কিসের ছায়া?” মীনা আর রীণাও দেখে একই দৃশ্য। কিন্তু, টেবিল আর দেয়ালের মধ্যে তো কোন বস্তু নেই। মনোজ পরীক্ষা করার জন্য উঠে গিয়ে মোমবাতি আর দেয়ালের মধ্যে হেঁটে যায়। দেখে যে একটিই ছায়া অবিকৃত আছে। মনোজের কোন ছায়া দেয়ালে পড়েনি। ঘরটি ছিল সরোজের। সবার মনেই একটা ভয় গ্রাস করেছে। খাওয়াদাওয়ার পরে চিন্তিত মনে সবাই যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে মনোজ ছোট বোনদের জানায় যে তাকে আজ আলমোড়া যেতে হবে। তার এক বিত্তবান রোগী খুব অসুস্থ। দুদিন পরে ফিরবে। দুদিন পরেও মনোজ ফিরলো না। রাতে দু’বোন মীনার ঘরে বসে। হঠাৎ মীনা ঘরের বাইরে বেরিয়ে বড়দার ঘরের দিকে এগোয়। হাতে মোমবাতি। ওই ঘরে ঢুকে দেখে সেই ছায়া আগের মতো একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে। ঠিক পরেই রীণাও ভয়ে ভয়ে পিছন পিছন গিয়ে ঘরে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে আগের ছায়ার পাশে আর একটি ছায়া চলে আসে। দুই বোন ভয়ে মূর্ছা যায়। নেপালী পরিচারক পরের দিন সকালে এসে দেখে দুই বোনের প্রাণহীন দেহ।

এর পর পরিচারক মনোজের অপেক্ষা করে। কিন্তু, মনোজ আর ফেরেনি। বাড়িটা এর পর ফাঁকা পড়ে আছে। নেপালী পরিচারক এখনো সেখানে আউটহাউসের ঘরে বাস করে।

বছর দুয়েক বাদে এক বয়স্ক দম্পতি ট্রেকিং করে পিণ্ডারির পথে যাচ্ছেন। কাপকোট থেকে রওনা হতে দেরী হয়ে গেছে। লোহারক্ষেতে ফরেস্ট বাংলোর রাতে থাকবেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর অনেক আগেই রাত নেমে আসে। তাও হাতের টর্চ জ্বেলে দুজনে এগিয়ে যান। ঠিক ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির কাছে বয়স্কা ভদ্রমহিলা অসুস্থ বোধ করেন। ভদ্রলোক বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি ঘরে আলো, মোমবাতি জ্বলছে। তিনি নেপালী ছেলেটিকে ডেকে আনেন। ছেলেটির সাহায্যে অনেক কষ্টে বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে সরোজের ঘরে নিয়ে তোলা হলো। এই একটি ঘরই পরিচারক পরিষ্কার রাখে, যদি মনোজ কোনদিন আসে। টেবিলের উপর মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় সে। একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে ভদ্রমহিলা বলেন বুকে ব্যথা করছে। নেপালী ছেলেটি বলল, লোহারক্ষেতে এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আছে। আমি ওকে ডেকে আনছি। নেপালী ছেলেটি চলে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে পড়লেন। ভদ্রলোকের চোখ এবার দেয়ালের দিকে পড়লো। তিনি দেখলেন দেয়ালের গায়ে পাঁচটি ছায়া। একে বারে মানুষের অবয়ব। স্থির দাঁড়িয়ে। একদিকে স্ত্রী অসুস্থ আর অন্যদিকে এই অলৌকিক দৃশ্য – তিনি বিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দেখলেন স্ত্রীর দেহটা একদিকে হেলে গেছে। অনেক ডাকাডাকি করেও ওঁকে জাগাতে পারলেন না। হাতের নাড়ীও পেলেন না। বুঝলেন প্রাণ নেই।

একটা প্রশ্ন দিয়ে গল্প শেষ করবো। মনোজের কি হয়েছিল?

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register