- 3
- 0
"আমি এখানে কেন"?
......ম্যানেজার বাবু আপনি ব্যাঙ্কে কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।ডাক্তারবাবু দেখে বলছেন আপনার ম্যালেরিয়া হয়েছে।কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
প্রশান্ত, অমল কলকাতা থেকে এসেছে কি, তোমরা কি কেউ দেখেছো তাকে? অমল এসে গেছে, কোন চিন্তা নেই আপনার। ওর কাছে সব চাবি দেওয়া হয়ে গেছে।
ভাগ্যিস তখন বিদ্যুৎ দা ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন না হলে তো আমরা কেউ জানতেই পারতাম না আপনার এই ধুম জ্বরের কথা।
বিদ্যুৎ দা পঞ্চায়েত প্রধান। বিদ্যুৎ দার জন্যই সব ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। সুবিমল আমার মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে আছে। সুন্দরবনের রাঙাবেলিয়া গ্রাম থেকে ভুটভুটিতে পাক্কা দুটি ঘন্টা লাগে সোনাখালী আসতে।
আমরা সোনাখালী এসে গেছি ম্যানেজার বাবু। মাধাই দা, সোনা দা, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।
মাধাই দা বিদ্যুৎ দার ডান হাত। কুমিরের মুখ থেকে তার বৌকে বাঁচাতে গিয়ে তার ডান হাতের কনুই থেকে বাদ দিতে হয়েছে কলকাতার পি.জি, হাসপাতালে। মাধাই 'দা আর খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে যায় না। বিদ্যুৎ দা'র সাথে পঞ্চায়েত অফিসে ফাই ফরমাস খাটে। মাধাই দা'র বৌ আবার আগের মত গোমর নদীতে নেমে মীন ধরে। পেটের দায় বড় দায়।
জলে কুমির , ডাঙায় বাঘ ,এর সাথে সুন্দরবনের মানুষের দিনে , রাতে ওঠাবসা। কারোর মনে কোন ভয়ের লেশমাত্র নেই। সব কিছু কপালের ওপর ছেড়ে দিয়ে বেঁচে নয়, টিকে আছে কোনরকমে যতদিন এইভাবে থাকা যায়। শহরের মানুষ সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গল্প শুনেছে, এখানের মাধাই দা, অর্জুন দা'দের গল্প শোনেনি।
রাঙাবেলিয়া থেকে যারা সোনাখালী পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে তারা সবাই ফিরে গেছে। ভাটার টানে মাতলা নদীর বুকে চর জেগে উঠেছে, নৌকো আর তো যাবে না, কি হবে এখন । এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে ও পাড়ে কি করে যাবো আমি সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখি নৌকো গেছে চরে আটকে। সবাই হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে ঝপাঝপ নৌকো থেকে জলে লাফিয়ে নেমে হাঁই, হাঁই করতে করতে ওপাড়ে গিয়ে ক্যানিঙ লোকাল ধরতে চাইছে।একটাই ট্রেন, তাও একঘন্টা পর পর।
মাধাইদা পরনের ধুতিটা মালকোচা করে বেঁধে আমার অতবড় শরীরটাকে এক হাতে এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নিয়ে মাতলার জলে নেমে থপথপ করে কাদা ভেঙে সোজা ষ্টেশনে। ষ্টেশন লাগোয়া টিউবওয়েলের জলে হাত পা ধুয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো আমাকে নিয়ে। আমাকে শুইয়ে দিলো ট্রেনের মেঝেতে,সোনা'দা ঠায় আমার মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে ছিল।
এখন একটু জ্বর কমেছে। মাধাইদা' কে বললাম দাদা বালিগঞ্জে নেমে ডাক্তার দেখিয়ে তারপরে আমি বাড়ি যাবো।রাত বারোটায় ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে যখন আমি বাড়ি এলাম তখন রাত দুটো। তখন মোবাইল ফোন আসেনি বাজারে, বাড়িতে ল্যান্ডফোন বলে কিছু নেই।
মিসেসের চোখ একেবারে ছানাবড়া। কাদের দেখছে এই মাঝরাতে। মানুষ না ভূত। আমি বললাম ভয় নেই , আমরা কেউ ভূত নই, ভূতগ্রস্ত মানুষ।
ডাক্তার বলেছে ম্যালেরিয়া, হসপিটালে ভর্তি হতে হবে আমি বালিগঞ্জে নেমে ডা: বিশ্বাস কে দেখিয়ে ওষুধ কিনে বাড়ি এসেছি।মাধাই 'দা, সোনা 'দা আমাকে রাঙাবেলিয়া থেকে মাতলা পেরিয়ে ক্যানিঙ হয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে।
সারা দিন এদের কিছু খাওয়া হয়নি।অত রাতে মাধাই'দা, সোনা' দা দুজনেই চান করে ,ডিমের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লো। পরের দিন ভোর হতে না হতেই তারা চলে গেল। আট ঘন্টার পথ।
আমাকে কাঁধে করে মাতলা নদীর চর ভেঙে মাধাই দার আসার কথা যখন বাড়িতে সবাইকে বললাম তখন কারোর মুখে আর কোন শব্দ নেই। সকলের মনে একটাই প্রশ্ন,, এও কি সম্ভব।?
মাধাইদা আমার কাছে দেবদূত হয়ে এসেছিল,এ আমার কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। বয়সকালে মাধাই দা 'র নামে সুন্দরবনে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। মাধাই 'দা রঘু ডাকাতের মতো সুন্দরবনের একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল। গরীবের ভগবান। কুমিরের মুখ থেকে নিজের বৌকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসা কি চাট্টিখানি কথা না কি? কনুই থেকে হাত আজ ওর নেই , মনটা আছে। ভয় সে কাউকে পায় না। অকুতোভয় শব্দটা অভিধানে আছে শুধু এই মাধাই দা' র জন্য।
একমাস পরে সুস্থ হয়ে আবার অফিসে গেলাম। কতদিন আর ছুটিতে থাকবো। ছুটির আয়ু তো তলানিতে এসে ঠেকেছে। অমল তো চমকে উঠলো আমাকে দেখে। ম্যানেজার বাবু আপনি? কেমন আছেন এখন। সেদিন আমরা যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সে আর বলার কথা নয়।
মাধাই 'দা আপনাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে সব বলেছে। সেদিন মাধাই 'দা না থাকলে আমরা যে কি করতাম কে জানে! নাম করতে না করতে মাধাই 'দা এসে হাজির।মুখে একগাল হাসি।
কেমন আছেন এখন ম্যানেজার বাবু? আজ আপনি দুপুর বেলায় আমাদের বাড়িতে খাবেন। আপনার বৌমা আপনার জন্য রান্না করে রেখেছে। মাগুর মাছের ঝোল ভাত খাবেন। এখন শিঙি, মাগুর আপনার খাওয়া উচিত।
সে তো বুঝলাম , কিন্তু যেটা বুঝতে পারছি না সেটা হলো তোমার বৌ কি করে জানলো যে আজকে আমি অফিসে আসবো।
আমরা জানি, আমাদের মন বলেছে আজ আপনি আসবেন। তাই আপনার বৌমা সাতসকালে নিজেই খ্যাপলা জাল নিয়ে পুকুরে নেমে পড়েছে। এমন কপাল আজকেই জালে দু দুটো মাগুর।
পুজোর সময়ে মাধাই দা' র জন্য ধুতি , পাঞ্জাবি, আর বৌদির জন্য একটা টাঙ্গাইল শাড়ি কিনে নিয়ে গেলাম। এত অল্পে যারা এত খুশি হতে পারে এর আগে আমি এমন কাউকে দেখিনি। তবু ও এদের ডাকাতি করতে হয় আজও।
মনে পড়ে গেল সেই কথাটা....* "বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে"।
মাধাই 'দা যখন আমাকে বলল , ম্যানেজার বাবু জীবনে এই প্রথম আমি গায়ে জামা পড়বো। এতদিন তো পরতে পারিনি ,তখন মাধাই 'দা কে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার চোখের জলটাকে আড়াল করতে চাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। যাতে ওর চোখে আমি ধরা না পড়ে যাই সেইটুকু আমি চেয়েছিলাম।
আমি তো শহরের লোক, শহরের লোকের এ-রকমটা ঠিক মানায় না।
0 Comments.