কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া
বই মেলা দর্শণ-গল্প
(বর্ণিত স্থান, কাল, পাত্র কৈল্পিক৷ কেননা প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের এ গ্রামটাতে কাকতলিয়ভাবে কিছু মিলে গেলে সেটার দায়ভার লেখকের নয়৷)
আয়াজ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে৷ এ সেক্টরে চাকরি হলো কচু পাতার পানি৷ এই আছে৷ এই নেই৷ সঙ্গতকারণে তার চাকরি আর কর্মএলাকা কম দেখা হলো না৷ বিষয়টাকে সে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে৷ কেননা সে হতাশাবাদী নয় বরং বাস্তববাদী৷ এটা একটা বড় গুন৷ একটা দক্ষতা৷ এটা জ্ঞানের প্রকাশ৷ আর জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠাভ্যাস জরুরি৷ সে প্রচুর বই পড়ে৷ বলা যায় বইয়ের পোকা৷
প্রতিবছর বইমেলায় মানুষের ঢল দেখলে তার ভাল লাগে৷ সে চায় সকলে বই পড়ুক৷ লেখক তৈরি হোক৷ কেননা যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি ততো উন্নত৷ কিন্ত ইদানিং মনে হচ্ছে এটা মিথ্যা কথা৷ শ্রিলংকায় প্রায় ৯৯% শিক্ষিত হওয়ার পরও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই করুণ যে সরকার কাগজের অভাবে পরীক্ষা স্থগিত করে দিয়েছে৷ নিজেদের মূদ্রার দাম এতই কমে গেছে যে চালের দাম ৫০০ শ্রিলংকান রুপি৷ ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকায় দেশ ছাড়ছে মানুষ৷ আয়াজ ভেবে পায় না কারণটা কী? তবে কি শিক্ষা ব্যবস্থাটা বাস্তব উপযোগি ছিল না? না কি শিক্ষার হারের তথ্যটা সঠিক নয়?
আয়াজের কখনো বই মেলায় যাওয়া হয়নি৷ অবশ্য ইচ্ছেও করেনি৷ তবে গত বছর চাকরির সুবাদে ঢাকায় ছিল৷ তাই ভেবেছিল এবার সে বইমেলায় যাবে৷ কিন্ত করোনার কারনে সরকার মেলা বন্ধ করে দেয়ায় যাওয়া হয়নি৷
এ বছর মেলা চলেছে পুরোদমে৷ সে কী তোলপাড়! গণ জোয়াড়! তার বেশ কিছু বন্ধু লেখক৷ তারা নতুন বই ছেপেছে৷ মেলায় উম্মোচন করবে৷ বন্ধুদের বেশিরভাগ বইয়ের প্রুফ দেখার কাজ যেহেতু আয়াজকে দিয়ে করানো হয়৷ তাই লেখক বন্ধুরা তাকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করে৷ সে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে৷ তবে ফেসবুকে লাইভে সে নিয়মিত বইমেলার হাল হকিকত জানতে পারে৷ কিছুদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে ফেসবুক লাইভে দিবা নিশি একজন বান্দরের মত লাফালাফি আর ঝাপাঝাপি করে প্রকাশ করছেন তার লেখা বইগুলো নাকি অত্যন্ত ভাল৷ শুধুমাত্র বইমেলায় নাকি তার বইয়ের শততম এডিশন হয়েছে৷ এমনকি এমন কথাও বলছেন যে তার বইয়ের দাম একটু বেশি৷ কারণ ভাল লেখকের বইয়ের দামটাও বেশি হয়৷ উনি কমদামি বই লেখেন না! আয়াজ পরে জানতে পারলো এই বান্দরটা নাকি বর্তমানে দেশের একজন নামজাদা লেখক! ভয়ঙ্কর অবস্থা৷ তবে কি বর্তমানের লেখকরা ম্যানার বা শালীনতা বোধটুকুও নষ্ট করে ফেলেছেন? এদের বই পড়া যাবে না৷ এই আচরণের লেখকদের বইয়ে কী-ইবা থাকবে যা দেশ-সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগবে? এসব দেখে বই মেলা দর্শনের ইচ্ছেটুকুই নষ্ট হয়ে গেল৷
আয়াজ এখন নিজ শহরেই থাকেন৷ করোনার কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানেই কিছু একটা করছেন৷ অনেক হয়েছে চাকরি৷ আর গোলামি না করে সে নিজে একটা এগ্রো ফার্ম প্রতিষ্ঠা করছে৷ তাছাড়া ছেলে-মেয়ে দুটোর লেখাপড়ার জন্য তার এখন নিজ শহরে থাকা দরকার৷ তার স্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভব নয়৷ একে যদি স্কুলে নিয়ে যাও তো ওকে কোচিং-য়ে৷
গত দুদিন আগে শুরু হয়েছে জেলা ভিত্তিক বই মেলা৷ আয়াজ ফেসবুক পোস্ট থেকে জেনেছে৷ এ বিষয়ে তার কোন কৌতুহল নেই৷ তার কিছু বন্ধু লেখক তাকে মেলায় আসার নেমন্ত্রণ করেছে৷ ঠিক আছে যাব বলে পাশ কাটিয়েছে৷
আগামি পরশু আয়াজের সন্তানদের ১ম সেমিস্টার পরীক্ষা৷ তাই তার মেয়ে তাকে একটা বাংলা ব্যাকরণ বই কিনে আনতে বললো৷ সে বই কিনে ফেরার পথে কী মনে করে অথবা বলা যায় কৌতুহল বসে বই মেলার সামনে দাঁড়াল৷ ভেতরে যাবে কি যাবে না দোটানায় পরলো৷ শেষে ঢুকেই পড়লো৷ চারিদিকে সাজ সাজ ভাব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তীব্র গানের আওয়াজ আর হৈ হুল্লোর দেখে মনে হলো মেলা বেশ জমে গেছে৷ ভাল লাগলো৷ সে একটা গেট দিয়ে ঢুকে তো অবাক! কীসের বই মেলা! বিশাল এলাকা জুড়ে স্টলে ভরপুর৷ এটা আসলে SME মেলা৷ ও ঘুরে ঘুরে দেখলো৷ কারুপণ্য৷ সেলাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে মেয়েদের অন্তর্বাস পর্যন্ত কিনিবিকি চলছে৷ প্রতিটি স্টলে দাঁড়িয়ে আছে সাজুগুজু করা সুন্দরি ললনা৷ মানুষের ভীড় বেশ৷
মেলার গেট পেরিয়ে আয়াজ দেখতে পেল বিশাল এক মঞ্চ৷ যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে৷ আর পুরো এলাকা জুড়ে আবালবৃদ্ধবণিতার ঢল৷ কিছু ছেলে মেয়ে মিউজিকের তালে তালে প্যান্ডেলের বাহিরে নাচে উম্মত্য৷ কিছুটা সময় সেখানে কাটালো৷ তার মনে হলো গানগুলো আর শ্রুতি মধুর নেই যেন শব্দ দুষণ৷
আয়াজ অবশেষে খুঁজে পেল তার কাঙ্খিত বই মেলা৷ ছোট্ট গেট৷ ভেতরে ঢুকে বহু কারণে সে অবাক! এত ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে ছোট ছোট স্টল৷ আচ্ছা তবে কি এটা বই মেলার জন্য মেলা করেছে! নাকি SME মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নামক সোনার সোহাগা হিসেবে বই মেলা আয়োজন করেছে৷ আরো আজব বিষয় এখানে প্রায় সব স্টলে সুন্দরি ললনারা দাঁড়িয়ে৷ পেশাদার বিক্রয়কর্মির ন্যায় মুখে হাসি নিয়ে অপেক্ষায় আছে ক্রেতার আগমনের জন্য৷ যদিও প্রায় ফাঁকা প্রতিটি স্টল৷ আচ্ছা এ শহরে কি পুরুষ লেখক নেই? যদি না-ও থাকে তথাপিও একজন লেখিকাকে মঞ্চের অভিনেত্রির মত উগ্র সাজে আর আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় বই বিক্রি করতে হবে কেন? একজন লেখক আর SME মেলার একজন বিক্রয় প্রতিনিধির কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না৷ আয়াজ লেখক নয় তাই সে বলতে পারছে না বই বিক্রি করা আসলে লেখকের নাকি প্রকাশকের দায়! জীবনের প্রথম বই মেলা দর্শনে হতাশ হয়ে লেখক বন্ধুদের ফোন করে জানতে পারে তারা চলে গেছে৷ আয়াজ রসিকতা করে বললো আসলাম ঠিকই কিন্ত তোমাদের সুন্দর মুখগুলো দেখা হলো না৷ একজন মজা করে বললো অসুবিধা নেই সুন্দরিরা আছে৷ সে বললো "আমি সুন্দর পছন্দ করি, শুধুই সুন্দরি নয়"৷
হতাশ হয়ে আয়াজ ফিরে আসছে এমন সময় গেটে এক বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার সাথে দেখা৷ ঠিকমত চলতে পারছে না৷ সে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো চাচা এগুলো কী বিক্রি করছেন? চাচা বললো, খেলনা, বাঁশি, হেড ব্যান্ড, পতাকা এই সব ব্যাটা৷ তারপর বলতে লাগলো সে বিহারী৷ বয়স নব্বই বছর৷ স্টেশনের পাশে থাকে৷ ১৯৭১ সাল থেকে সে এই ফেরি ব্যবসার সাথে জড়িত৷ তিন ছেলে দুই মেয়ে৷ সকলেই বিবাহিত৷ আলাদা থাকে৷ বাড়িতে অসুস্থ্য স্ত্রী৷
ছেলেরা দেখাশুনা করে না?
অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে কান্নামাখা কন্ঠে বললো "বাবারে বউরা রুপ যৌবণ দিয়ে ওদের ভুলিয়ে দিয়েছেরে বাবা! নাহলে কি এই বয়সে আমাকে ফেরি করতে হয়?"
আয়াজ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে ফিরতি পথে হাঁটতে লাগলো৷ আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো চাচা শুধু আপনার বউমারা নয় আমরা সবকিছুকেই, এমনকি সম্পর্কটাকে পণ্য বানিয়েছি৷ আর হয়ে গেছি Sex appeal এ ঠাঁশা একেকজন নষ্ট ফেরিওয়ালা৷
0 Comments.