Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব - ৯)

maro news
জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব - ৯)

মায়া - মফস্বল ও ক্যাংলাসপার্টিরা 

পর্ব ৯

স্বখাত সলিল, শীত এবং সার্কাস

ঠোঙার শেষ বাদামটা যেমন সবসময়ই পচা বেরয়, তেমনি মামারবাড়ি ভ্রমণের ফিরতি পথটাও। সব যেন বিচ্ছিরি, সব যেন খালি। মায়ের মুখ চিমনির কালির মতোই। কে না জানে শ্বশুরবাড়ির ময়নার থিকা বাপেরবাড়ির কাউয়ার গলা মিঠা লাগে।
গেছিলাম পঞ্চমীর দিন সকালের ট্রেনে। তখন রেললাইনের দুপাশে শস্যশ্যামলা পৃথিবী, তার ওপর শরতের পাটভাঙ্গা রোদ্দুর, ফিরছি কালীপূজোর দু-একদিন আগে, শেষ বিকেলের ট্রেন, বাইরে বিষণ্ণ হেমন্ত। তার ছায়া দূরের দূরের গ্রামগুলোকে ঘিরে ফেলছে। ওগুলোর মধ্যেরই একটি গ্রাম ছেড়ে আবার ফিরে আসছি মায়া মফস্বলে, ওই তো দেখতে পাচ্ছি খিড়কি পুকুরঘাটে দাড়িয়ে দিদা ম্লান মুখে হাত নাড়ছে, ট্রেন থেকেও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেই বরাভয়ের মত হাত। এসেছিলাম ঝলমলে শরতের সকালে, ফিরছি  হেমন্তের বুকে চেপে বসা সন্ধেয়। এক ব্যাগ না ছোঁয়া বই বুকের ভার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামনেই, যাকে বলে খুবই সন্নিকটে বার্ষিক পরীক্ষা। সমারসেট মমের ‘আ বুক ব্যাগ’ বলে একটা ভয়ঙ্কর গল্প আছে। আমার বইয়ের ব্যাগটাও ওইরকম হাড় হিম করা!
এই সময় মনের যে অবস্থা হত, তাকে এককথায় বলা যেতে পারে শ্মশানবৈরাগ্য। সারা পুজোয়, হটুগঞ্জ যুগের যাত্রী ক্লাবের ছেলেরা ভোর থেকে ধনঞ্জয় পান্নালাল চালিয়ে চালিয়ে কানের পোকা বার করে ফেলেছে, একটু বেলায় আসরে নামতেন হেমন্ত, লতা, মান্না, কিশোর, আশা, আর বিকেল থেকে ‘শিলোরি বিনা চাটনি ক্যায়সে বনি’, কিংবা ‘আই অ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার’। সেইসময় ‘আপ জ্যায়সা কোয়ি মেরি জিন্দেগি মে আয়ে, তো বাত বন যায়ে’ - - নাজিয়া হাসানের এই আলোড়ন ফেলা গানটা শুনে আমার এক বন্ধু ফিসফিস করে বলেছিল, বুঝলি, এটা না বড়দের গান, কারণ সে এটা শুনেছিল ‘আপ জ্যায়সা কোয়ি মেরি জিন্দেগি মে আয়ে, তো বাপ বন যায়ে’!!!
সে এক অলীক সময়। যখন পুজোর পরেই বেজে উঠত বার্ষিক পরীক্ষার দামামা। কয়েক প্রজন্মকে বঞ্চিত করে অবশ্য আবার সে এসেছে ফিরিয়া। তখন আমরা প্রায় একমাস পর বই খুলে টের পেতাম অচেনার আনন্দকে ঘরে বসে পাবার এটাই সেরা পন্থা। প্রত্যেকে তখন অপুর মত বিস্ময় বালক বা বালিকা। রূঢ় উপত্যকা , ঐকিক নিয়ম বা রাধার পূর্বরাগ সমান অচেনা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিটি কারণ আমার আসন্ন পতন ও মূর্ছার জন্য দায়ী। সেসময় এই পুজোর প্যান্ডেলে বাজা শ্যামাসংগীতগুলো কী যে সান্ত্বনা নিয়ে আসত! পান্নালাল, ধনঞ্জয় হয়ে উঠতেন মেসিয়া। দু চারটে উদাহরণ দেওয়া যাক।
আমি সকল কাজের পাই হে সময়, তোমায় ডাকিতে পাইনে। -এই প্রথম উপলব্ধি, যে সারাবছর কোন ফূর্তি বাদ যায়নি, কিন্তু পড়ার সময় হয়ে ওঠেনি।
দোষ কারো নয় গো মা/আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা – এর পর মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। দোষ আর কাকে দেব? সারাবছর তো বই ছুঁইনি।
ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো উড়ে যাচ্ছে। দুনিয়াদারির এই নিয়ম কাকা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে প্রাণের বন্ধুও একটা উত্তর বলে সাহায্য করবে না। হল কালেকশন শুধু মায়া প্রপঞ্চময়।
কোথা ভব তারা, দুর্গতিহরা, এতদিনে তোর করুণা হবে। এ গানটা পরীক্ষার দিন বড্ড মনে পড়ছে। আজ যে মা তারার করুণা ছাড়া তরা মুশকিল।
আমি চাইনা মাগো রাজা হতে
দুবেলা দুমুঠো পাই যেন খেতে
এটা পরীক্ষার খাতা জমা দেবার পর। ফার্স্ট সেকেন্ড হতে চাই না মা। কোনরকমে পাস করিয়ে দাও।
মাগো আনন্দময়ী, নিরানন্দ কোর না।
মাগো, তুমি কি জানো না শীতে রাসমাঠে সার্কাস আসছে? তাছাড়া পিকনিক, নেহরু চিল্ড্রেন্স মিউজিয়াম আরও কত মজা। কোনরকমে উদ্ধার করে দাও মা।
হায়, এখনকার বাচ্চাদের পান্নালাল ধনঞ্জয় নেই। তাই একজাম ফ্রাইটে তাদের মনস্তত্ত্ববিদের হিমশীতল খুপরি ঘরই ভরসা।
আকাশ এখন নীল চামচের মত চকচকে, সোনার জলে লেখা চিঠির মত রোদ বারান্দায় এসে পড়ে আছে, আর সেই বারান্দায় বসে আমি খুলে  আছি ইতিহাস বা ভূগোল বই- আমার চিরকালের বিভীষিকা। এমনকি, পোষা পাখির মত যে অংক, সেও ছিকলি কেটে উড়ে যেতে চাইছে। তৈলাক্ত বংশদণ্ড বেয়ে ওঠা বাঁদরটা কেবলি দাঁত খিঁচোচ্ছে, ছেলের বয়স বাবার থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে, লোকসংখ্যা বাড়িয়েও সেতু  বা রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করা যাচ্ছে না!
সেই ছেলেটাকে এইসময়ে খুব মনে পড়ে। যার দিদির বিয়ের অব্যবহিত পরেই পরীক্ষা শুরু হবে, সদ্য সম্পর্কিত জামাইবাবু তাকে বললেন ভূগোল বইটা খুঁজে আনতে। ঘন্টাদুয়েক পর অনেক খুঁজে পেতে একটা মলাট ছেঁড়া বই এনে সে জামাইবাবুকে সরলভাবে জিজ্ঞেস করল ‘দেখুন তো জামাইবাবু, এটা ভূগোল বই কিনা?’
না, না, আমি অতটা খারাপ ছিলাম না। ভূগোল আর ইতিহাস বইয়ের তফাত  অন্তত করতে পারতাম, তবে এই ছেঁড়া মানচিত্র আর পোকায় কাটা ইতিহাসের সময়ে করতে পারি না আর।
রূঢ় উপত্যকার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে যেতে শুনতে পাই রাসমাঠে তাঁবু পড়ছে। সার্কাস, সার্কাস! নটরাজ, জেমিনী, নিউ ইন্ডিয়ান – কে আসেনি? এখনকার পশুবিহীন মাজাভাঙ্গা সার্কাস নয়, বাঘ, সিংহ, ভালুক, জলহস্তীতে একেবারে ফুল্টু এন্টারটেনমেন্ট।আর হুরী পরীর মত সুন্দরী মেয়েরা। তাঁবুর ফুটো দিয়ে যাদের দেখতে ভিড় করে গোটা মফস্বল।এ শহরে চার-চারটে সিনেমা হল। রাসমাঠ পেরোলেই শো হাউস, ফুলতলায় লীলা, স্টেশন রোডে মিলন, আর কাছারিবাজারের দিকে যেতে কৃষ্ণা। শো হাউস ছাড়া বাকি হলগুলোতে হিন্দি ছবি সারা বছর। এই চারটে হলের হিন্দি, বাংলা, কখনো কখনো ইংরেজি সিনেমার রূপসী নায়িকারা এই একমাস সার্কাসের মেয়েদের কাছে ম্লান।
আমাকে তাঁবুর ফুটোয় চোখ রাখতে হয়নি কখন। কারণ প্রতিবছর আমাদের নিচতলায় থাকতে আসেন তাঁরা। কে না জানে, সার্কাসের স্টার প্লেয়াররা তাঁবুতে থাকেন না, তাঁদের জন্য ভাড়া নেওয়া ভালো বাড়ি। আমাদের বাড়িটা একেবারেই রাসমাঠের লাগোয়া। এখানেই মেকআপ নিয়ে তাঁবুর পেছন দিয়ে ঢুকে পড়তে তিন মিনিটও লাগত না।তাই প্রতিবার এই বাড়িতেই থাকতে আসতেন তাঁরা। গোবিন্দকাকুর বন্ধু গেদুকাকু,  সার্কাস দলের ম্যানেজারি করে বেড়ান ভারত জুড়ে, তিনিই প্রতি বছর এই আবদার নিয়ে আসতেন। সার্কাসের লোক বাড়ি নোংরা করে দিয়ে যাবে, মায়ের এমন প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গেদুকাকুই বিজয়ীর হাসি হাসতেন। তাই প্রায় প্রতিবার, দেশের নানা প্রান্ত থেকে শীতের পরিযায়ী পাখির মতো, আসতেন তাঁরা। বুকে হাতি তোলা বিখ্যাত রুবি বিশ্বাস থেকে ট্রাপিজের তুখোড় খেলোয়াড় মালয়ালি চার বোন। শীতকালে আমাদের বাড়িটা হয়ে উঠত মিনি ভারতবর্ষ।
মার বদ্ধমূল ধারণা সার্কাসের লোকজন খুব নোংরা হয়, তাঁরা গেরস্ত বাড়িতে থাকার যোগ্যই নয়, তাঁবুই তাদের পক্ষে ভালো। কিন্তু মার সেই ধারণা ভেঙে দিল মনোরমারা। কেরলের মেয়ে মনোরমারা চার বোন সার্কাসে ব্যালেন্সের খেলা দেখায়, ট্রাপিজও করে। ওদের বাবা কুট্টি খুব বড় খেলোয়াড় ছিলেন একসময়। পায়ে চোট পেয়ে  এখন ক্লাউন সাজেন। চার মেয়েকে নিয়ে কুট্টি থাকতে এলেন আমাদের বাড়ি।
মেয়ে চারটি যেন চার পরী। আর কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এসেই আমাদের উঠোনে সারসার ফুলের টব সাজিয়ে ফেলল, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালাল।প্রতিটি ঘরের সামনে চালের গুঁড়ো, হলুদে, সিঁদুরে রঙ্গোলী। আর তেমন অপূর্ব তাদের রান্নার হাত। প্রতিদিনই কিছু না কিছু রেঁধে ওপরে পাঠাত। তাদের সঙ্গে ছিল একটা ঝুরো লোম সাদা স্পিৎজ। একমাস পরে যখন কুকুর, ফুলের টব, রান্নার গোপন মশলা নিয়ে তারা চলে গেল, আক্ষরিক অর্থেই আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। চার বোন যখন সার্কাসে সাইকেলের নানা কসরত দেখাত, তখন কচি থোড়ের রঙের তাদের উরুগুলো যেন কোন ঘুরন্ত প্রাসাদের অলীক স্তম্ভের মতো লাগত। বহুবার  স্বপ্নে সেই স্তম্ভগুলো ফিরে ফিরে আসত। আমি কি বড় হয়ে যাচ্ছি?

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register