Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

মেহফিল-এ-কিসসা রণজিৎ সরকার

maro news
মেহফিল-এ-কিসসা রণজিৎ সরকার

মায়ের দেহত্যাগ

হরিদহ গ্রামে রায় বাড়িতে মানুষজন এসে ভিড় করেছে। নানা পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। পরিতোষের মা অনিতা কান্নাকাটি করছেন। মাটিতে দুই হাত আছড়ে কান্না করছেন। চুলগুলো এলোমেলো। হাতে যদি শাঁখা, চুড়ি থাকত তাহলে শাঁখা ভেঙে যেত। কিন্তু গত কয়েক মাস হলো পরিতোষের বাবা হরিপদ হার্ট অ্যার্টাক করে মারা গেছেন। সন্তানকে হারিয়ে মা এখন পাগল প্রায়। মা বিলাপ করে বলছেন, আমার সোনা বাবা কোথায় গেল রে। কোথায় পাব আমার সোনার বাবাকে। কারা খোঁজে দেবে আমার সোনা সন্তান পরিতোষকে...।
ঘিরে ধরা মানুষজন বিভিন্ন রকমের কথা বলছেন। কেউ বলছেন, আপনার সন্তান কোথায় গেছে জানি না, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, টাকাগুলো ফেরত দেন। সুদ লাগবে না, শুধু আসল টাকা দিলেই হবে। অন্য কেউ বলছেন, আপনার গরু বিক্রি করে আমার টাকা উঠিয়ে নেব। আবার কেউ কেউ বলছেন, যেমন করে হোক টাকা চাই। আপনার চোখের জলে আমাদের টাকা শোধ হবে না। ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, বের করেন, টাকা দেন।
একজন একজিও কর্মী উত্তেজিত হয়ে বললেন, কান্না শুনতে আসিনি। অভিনয় বাদ দিয়ে টাকা দিবেন কি করে সেটা চিন্তা করেন। ছেলে পালিয়ে গেছে তাতে কি, এনজিও টাকা ছাড়বে না। টাকা কবে কখন দেবেন, বলেন?
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাড়ির সাধনা। সাধনা ফনীন্দ্রের স্ত্রী। ফনীন্দ্র গ্রামে থাকেন না। থাকেন ঢাকা শহরের। পরিতোষ সাধনাকে বউদি বলে ডাকতেন। সাধনা এনজিও কর্মীর কথা শোনার পর বললেন, আপনি কি বলেন, সন্তান হারা কোন মা অভিনয় করে কান্না করতে পারে। কখনই পারে না। আপনার ঘরে কি সন্তান নেই?
লোকটা রেগে গিয়ে বললেন, সন্তান আমাদের ঘরে আছে। কিন্তু পরিতোষের মতো অজাত সন্তান আমাদের ঘরে নেই। ওর নামে যা শুনছি, তা বলার মতো না। ওষুধের দোকান দেখিয়ে কত জনের কাছ থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছে জানেন। হয়তো জানেন না। আমরাও জানতাম না। এখন অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
ওনার কথা শেষ না হতেই পাশ থেকে একজন বললেন, আপনি কি পরিতোষের কাছ থেকে কোন সুবিধা নিয়েছেন। পাশের বাড়ির সুন্দরী বউ আপনি। পাশের বাড়ির সুদর্শন যুবক পরিতোষ। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সম্পর্কের কিছু একটা জায়গা আছে, আপনাদের হৃদয় মাঝে। সম্পর্ক থাকলে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি বললেন, এত টাকা কীভাবে দেবে পরিতোষের মা?
সাধনা লোকটার কথা শুনে রেগে বললেন, ‘আপনি মুখ সামলে কথা বলেন। অভদ্র কোথাকার। আমি সব সময় ন্যায় কথা বলি। আপনার টাকা আছে, অহংকারও আছে। টাকা হলে মানুষের অহংকারও বাড়ে। আপনাকে দেখে আজ আবারও প্রমাণ পেলাম। খবরদার পরিতোষ আর আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় বার কোন খারাপ কথা বলবেন না।
পাশে পরিতোষের কাকা তো ভাই পলাশ তাকিয়ে আছে সাধনা বউদির দিকে। তাকিয়ে পলাশ ভাবছে- ডাইনি বউদি, তোমার কারণেই তো পরিতোষ দা আজ পলাতক। এখন তুমি বড় বড় কথা বলছ। তোমাদের পরকীয়া সম্পর্ক হওয়ার পর পরিতোষ দার কাছ থেকে হিসাব ছাড়া টাকা নিয়েছ। আমি তো সাী। রুম পাহারা দেওয়ার সাী।
পলাশ মুখ ফুটিয়ে এই মুহূর্তে কথাগুলো বলতে পারছে না। সে চুপচাপ আছে। অসৎ ও মিথ্যার কাছে পূর্ণিমার রাত আজ তার কাছে অমাবস্যার রাত মনে হচ্ছে।
একটু পর একজন বললেন, পরিতোষের নিখোঁজ হওয়ার কথা শোনার পর থেকে টাকার শোকে আমার মাথা ঠিক নেই। টাকাগুলো যদি না পাই তাহলে আমার বড় তি হয়ে যাবে। কারণ সামনে আমার মেয়ের বিয়ে।
সাধনা এবার বললেন, পরিতোষ বেঁচে থাকলে টাকা পাবেন। আগে বের হোক। মায়ের সন্তান মায়ের কোলে ফিরে আসুক। তারপর না টাকা পয়সার হিসাব।
বিভিন্ন জন নানা রকম কথা বলেই যাচ্ছে। পরিতোষের মা কান্না যাচ্ছেন। কারও কোন কথার উত্তর দিচ্ছেন না। উত্তর দেওয়ার মন মানসিকতা তার নেই। পাওনাদারা বিভিন্নভাবে কথা বলছেন। পরিতোষের কাকা নরেশ এসে বলছেন, আপনার কোন চিন্তা করনে না। পরিতোষ বের হোক, তারপর একটা ব্যবস্ত করে আপনাদের টাকা দেওয়া হবে। আপনার একটু ধৈর্য ধরুন। বউদিকে এখন মানসিক সাহযোগিতা করা খুবই প্রয়োজন।
কিছুক্ষণ পর পরিতোষের মা ধীরে ধীরে বললেন, আমার সন্তানকে খুঁজে বের করে দেন। পরিতোষ ফিরে এলে  সবাই সব টাকা পাবেন। এই কথাগুলো বলে আবার কান্না করতে লাগলেন। একটু পর অজ্ঞান হয়ে গেলেন মা।
উপস্থিত অনেক লোক চলে গেলেন। বিভিন্ন রকম কথা বলতে বলতে।
পরিতোষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হালখাতার দিন রাতেই সে দোকান থেকে নিখোঁজ।
নানা জনের চিন্তা নানা রকম। কেউ ভাবছেন গুম হয়েছে। খুন হয়েছে। কেউ বলছে পাওয়াদাররা তাকে নিয়ে গেছে। কেউ বলছেন নারী ঘটিত কোন বিষয়ে সে হয়তো নিখোঁজ হয়েছে।
কয়েক দিন হয়ে গেল। কোন খোঁজ নেই। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীস্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ পরিতোষের খবর জানে না। কোথায় আছে পরিতোষ।
কয়েক দিন পর হঠাৎ পলাশের ফেসবুকের মেসেঞ্জারে একটা আইডি থেকে কল এলো। কল রিসিভ করে পলাশ বলল, কে?
ওপাশ থেকে বলল, পলাশ আমি পরিতোষ। কাউকে কিছু বলিস না। আমি এখন ইন্ডিয়া। মা কেমন আছে রে?
ও আচ্ছা, তুই জীবিত আচ্ছিস।
হ্যাঁ,
মা কেমন আছে বলো?
তুই নিখোঁজ হওয়ার পর কাকীমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ। তোর জন্য কান্না কাটি করেই দিন রাত কাটাচ্ছে। কাকীমা এখন প্রায় পাগলীদের মতো আচারণ করছে।
পলাশ ভাই আমার। তুই কাউকে বলিস না আমি ফোন করেছি। শুধু মাকে বল। আমি ইন্ডিয়া চলে এসেছি। এখানে রমা মাসির বাড়িতে উঠেছি। মাসি মেসো ও ভাইবোনদের আমার চলে আসার বিষয় সব খুলে বলেছি, আমি ঋণের দায়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছে। কাউ আমার খোঁজ নিতে চাইলে তারা বলবে না, এখানে এসেছে। তুই শুধু মাকে বলিস, আমি মাসির বাড়িতে ভালো আছি। মায়ের সাথে আমি কথা বলব। মায়ের সাথে কখন কথা বললে ভালো হবে।
ঠিক আছে পরিতোষ দা। আমি কাউকে বলব না। তবে শোন, তোর মায়ের সাথে কথা বললে রাতে ছাড়া হবে না। আমি কাকীকে বলে রাখব। যখন কথা বললে কেউ টের পাবে না তখন কথা বলাই ভালো। আমি মেসেঞ্জারে জানিয়ে দেব। তুই মেসেঞ্জার চেক করিস।
ঠিক আছে পলাশ।
তাহলে এখন রাখি। প্লিজ কাউকে বলিস না ভাই।
আমি কাউকে বলব না। বিশ্বাস রাখ। তবে ভারতে গেছিস ভালো করেছিস। বাংলাদেশে মেয়েদের পেছনে টাকা পয়সা নষ্ট করেছিস, ভারতে যেন সেটা না হয়, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর।
আমি ভালো হয়েছে যাব রে পলাশ। তুই একটু মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দে। মায়ের সাথে কথা না বললে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার।
ঠিক আছে পরিতোষ দা। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
ওদের কথা বলা শেষ হলো। পলাশ কাকীমাকে খুঁজতে লাগল। দেখে ঘরের কোণে হাঁসমুরগি ঘরের পাশে বসে আছে। পলাশ কাছে গিয়ে বসল। তারপর বলল, কাকীমা একটু কথা আছে?
মায়ের মন তো টের পেল সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পরিতোষের খোঁজ পেয়েছিস!
চুপ থাকেন। পরিতোষের খোঁজ পাওয়া গেছে। আমার সাথে কথা হয়েছে। ও ভারতে আছে। রমা মাসির বাড়িতে।
পলাশের কথা শোনা মাত্র পরিতোষের মা যেন স্বর্গ এসে হাজির হলো। মুহূর্তে তার চোখ মুখ সন্তানের খোঁজ পাওয়ার আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল।
হাসিমুখে বললেন, পরিতোষ কেমন আছেন পলাশ?
ভালো আছে। রাতে আপনার সাথে কথা বলবে। আপনাকে ডাকব দেব। কেউ যেন টের না পায়, তখন ডাকব।
ঠিক আছে পলাশ। এই বলে মা দু হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল।
রাত হলো। পলাশ মেসেঞ্জারের জানাল এখন কথা বলা যাবে। ও পাশ থেকে পরিতোষ কল দিল। পলাশ কল রিসিভ করে পরিতোষের মাকে দিল। মা হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বললেন, বাবা তুমি ভালো আছ?
আমি ভালো আছি মা। তুমি চুপ করো পাশের কেউ টের পাবে।
তুমি আমাকে না বলে এমন কাজ করে ভারত চলে গেলে। এখন যে পাওয়ানাদারা আমার কাছে এসে পাড় ভাগছে। কত কথা শুনাচ্ছে। আমি কি করব বাবা। আমাকে রক্ষা করো।
মা তুমি কোন চিন্তা করো না। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য আমি পালিয়ে চলে এসেছি। আর তুমি কোন চিন্তা করো না। তোমাকে কিছু দিন পর সুযোগ মতো ভারতে নিয়ে আসব।
এত পাওনাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কি আমি বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যেতে পারব বাবা?
মা, তুমি কোন চিন্তা করো না, আমি সব ব্যবস্থা করব। আমি যে দালাল ধরে এসেছি। সে দালালের মাধ্যমে তুমি আসবে। এতে তোমাকে পলাশ সহযোগিতা করবে।
পলাশ বলল, কাকীমা এখন আর বেশি কথা বলেন না। কেউ টের পেলে সমস্যা হবে। দেন আমি একটু কথা বলি পরিতোষ দাদার সাথে।
মা সন্তানের কথা কি শেষ হয় না। তবু নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কথা বলা বন্ধ করতে হলো।
পরিতোষ আর পলাশ বিভিন্ন বিষয় কথা বলল। মাঝে মাঝে পলাশের কাছ থেকে পরিতোষ মায়ের খবর নেয়।
পরিতোষের অভাবের তাড়নায় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতে লাগলেন। নিজের জীবনটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্য দিকে পাওয়াদারদের চাপ তো অব্যাহত আছেই।
কিছুদিন পর পরিতোষ সব ব্যবস্থা করে মেসেঞ্জারে কল করে পলাশকে সব বলে দিল। পলাশ কাকীমাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত নিয়ে গিয়ে দালালের কাছে পৌঁচ্ছে দেবে। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে ভারতে চলে যাবে। পাসপোর্ট ভিসা করতে গেলে  অনেকেই টের পাবে। তখন আর যাওয়া হবে না। বড় রকমের সমস্যা পড়বে মা ছেলে।
পলাশ কাকীমাকে ভোরে যশোরের একটা গাড়ি তুলে দিলেন। পলাশ কাকীমার সাথে নিজে না গিয়ে তার এক বন্ধু সুমনকে সঙ্গে দিলেন। কারণ পলাশ সাথে থাকলে এলাকার অনেকেই টের পেতে পারেন। তাই তার বন্ধুর সাথে পাঠিয়ে দিল।
বেনাপোল পৌঁচ্ছালেন। দালালকে কাছে পেয়ে সুমন পরিতোষের মাকে দিয়ে বললেন, ঠিক ঠাক মতো পার করে দিয়েন।
দালাল বললেন, কোন সমস্যা নেই। আমাদের কাজই তো মানুষ পার করা। আপনি চলে যান। নিশ্চিন্তে।
সুমন চলে এলো।
রাতে দালালরা পরিতোষের মাসহ আর কয়েক জন নিয়ে চোরাই পথে পার করতে লাগল। তারকাটা পার হয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর বিএসএফ টের পেল। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল। পরিতোষের মাসহ আর দুইজন নিহত হলেন। পরদিন সংসাদ মাধ্যমে জানতে পারলেন মা বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন।
পরিতোষের চোখ থেকে টুপ করে জল পড়তে লাগল। মা হারানোর বেদনায় মনে মনে ভাবতে লাগল ঋণের দায়ে করলাম দেশত্যাগ। আর আমার কারণে মা করলেন দেহত্যাগ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register