Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্য বোলো না -তে অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

maro news
গদ্য বোলো না -তে অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

জীবন-যাপন কোলাজ

১ – যারা তুমুল বৃষ্টিতে ভিজেছিল । এভাবেও বাঁচা যায় ? আমরা যারা বড় হয়েছি তুমুল সামাজিকতার ঘেরা টোপে পালে-পার্বনে,দুঃখে,জীবন ব্যর্থতায় । একই থালা বাড়ানো তেরো গ্রাসের সংস্থান । পাড়ার বৃদ্ধের সাথে পাল্লা দিয়ে রাত জেগে আছি হাসপাতালের বাইরে ।সন্ধ্যা থেকে রাত গড়াত সব উঠোন একসাথে লুডু খেলার ঝুঁকে পড়া মাথাগুলির অস্থিরতায় অথবা এক কলি গেয়ে ওঠা রবীন্দ্রসংগীতে গলা মিলিয়ে কোরাসে হয়ে ওঠা । অস্তিস্ত্বের টুকরো-টাকরা কোলাজে মিশে গিয়েছে সংসার-সমাজ-প্রতিবেশী-বন্ধু-ক্লাব । ভ্যান ঘঘের সানফ্লাওয়ার ছবি বা চাষি পরিবারের সন্ধ্যাবেলার একসাথে আলুসেদ্ধ খাওয়ার ছবির উজ্জ্বলতা নিয়ে শিল্পীর আত্মহত্যার নীলাভ দুঃখে লোডশেডিং অন্ধকারে আমাদের তুমুল কলরব বেকারত্ব জীবন-যৌবনের ব্যর্থতাকে ম্লান করে দিয়েছে । ভাগ করা সিগারেটের ধোঁয়ার দুভাগ হয়ে যাওয়া রাজেশ খান্নার রোমান্টিক ব্যর্থতা আর অমিতাভের এংরি ইয়াংম্যানের আবির্ভাব আমাদের টালমাটাল করে দিচ্ছিল ।আড্ডাশেষে যে যুবক রাতের আঁধারে ভাঙ্গা সাইকেলে ক্যাচোর-ম্যাচোর করে বাড়ি ফিরত । আকাশের আধফালি চাঁদ আর বুকের মধ্যে সাপ্টে চাবুকের বাড়ি –ম্যাঁয় যাঁহাসে খাড়া হু উহাসে লাইন শুরু হোতা হ্যায় । চুপিসারে বাড়ি ঢুকে হ্যারিকেনের আলো অল্প উস্কে দিয়ে ঢাকা দেওয়া ভাত খেয়ে নিয়ে কলপাড়ে থালা মেজে রেডিওটা নিয়ে চলে যেত ঘরে ।মৌমাছি অন্ধকারে বিছানা গ্রাস করে নিত শরীর ।কলপাড়ের ছিটিয়ে থাকা এঁটো ভাতের উপর জ্যোতস্নার ঝিলিক লেগে ত্থাকত । ঘর পেরোলেই ধানক্ষেত ।হাওয়ায় শনশন করে ওঠে ধানের বুকে দুধ আসা নবান্নের ঘ্রাণ । অন্ধকারেও জেগে থাকে শ্বাশত মা । ঘুমন্ত ঘোরের মাঝেও তার চম্পক আঙ্গুল দ্বারপাল হয়ে ছুঁইয়ে থাকে কপালের বিধির লিখন আর পাশাপাশি শাঁখা-পলার সহাবস্থান । যে যুবক গলা চিরে বলেছিল – স্ফুলিঙ থেকে অগ্নিশিখার একটি নাম – লেনিন । যারা দেয়াল জুড়ে লিখেছিল – এশিয়ার মুক্তিসূর্য – ইন্দিরা । গনসংগঠনের লাল পতাকায় অগ্নিখাক দিনগুলির ইস্তেহারের বারুদ ভরা আগুন নিয়ে যে যুবকেরা পথে নেমেছিল – আমূল ভুমিসংস্কার চাই । জমি টুকরো হল ।ভাগ হয়ে গেল লাল ঝান্ডার দাপটে । হুড়মুড়িয়ে পাহাড় ভাঙ্গা বৃস্টিতে শরনার্থীর দলে ভরে গেল শহর ।উত্তেজনার কম অবকাশ ছিল না ভাঙছিল ,গড়ছিল বিভিন্ন ছাঁচে । কিশোর থেকে যৌবনে পৌঁছনো পাড়া- সমাজ –ক্লাব-পার্টি-পরিবার এই নানা জায়গার ধাক্কা খেতে খেতে একটা শেপ থেকে আরেকটা শেপে চলে যাওয়া যায় দ্রুত । ঝান্ডার একটি নাম- চাকরি । ঝান্ডার একটি নাম- স্থিতবস্থা । ক্ষয় শুরু হল । আমরা যারা তুমুল বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম একইসাথে । আমরা যারা একই জোতস্নার পরাগ মেখেছিলাম । আমরা যারা একটি নিশানাকে টার্গেট করেছিলাম । আমাদের একই কমিউন বাসের লৌহঘরের ছিদ্রপথে আমাদের আলাদা অস্তিস্ত্বের অহংকে ধুনি জ্বালিয়ে দিল – পদের দাপ্ট আর ঘিরে থাকা স্তাবক মৌমাছি । আলাদা আলাদা টংঘরে একক অস্তিত্বের লাইটহাউসের বাসিন্দা হচ্ছিলাম । দর্শনের শেষের পথ সন্ধান না প্রতিদিনের পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সামলানো – এই দ্বন্ধ কিছুদিন কুঁরে কুঁরে খেলেও তারপর কি সুন্দর খাপে খাপে সেট হয়ে নব উত্তরণের পথে হাঁটা শুরু করলাম । পিছনে পরে থাকল কৈশোরের, যৌবনের বিস্ময় ভরা চোখ । যে যুবকেরা হাইড্রেনের ধারে দেওয়ালে কালো কালি আঁকাবাঁকা লিখেছিল – বন্দুকের নল সমস্ত ক্ষমতার উতস । তাদেরকে এ শহর চেনে । প্রশ্রয় দিয়েছে একসময় । তাদের কেউ কেউ শশ্মানে পট্টবাসে ঘোর অমাবস্যার রাতে লেলিহান রক্তাক্ত জিহ্বার সামনে কলজে ফাটিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে – সংসার ধর্ম বড় ধর্ম মা ।

২ – যারা শব্দছক মিলিয়েছিল । যারা ইউরোপের দেশগুলিতে বেড়াতে গেছেন লক্ষ্য করে দেখবেন প্রত্যেকটা বাড়ি একটি আলাদা আইডেনটিটি । এই আলাদা আইডেন্টিটির মধ্যেও এক নির্দিষ্ট ছাঁদ আছে । সামগ্রিক মিলিয়ে একই রকম । একই শেপ । আমাদের দেশের মত নয় । বিশাল অট্টালিকা তার পরেই একটা একতলা বাড়ি তার পরেই বস্তী । তার পরেই লন্ড্রি ইত্যাদি । এটা একটা সময় একঘেঁইয়ে লাগে আমাদেরটা মানিয়ে যায় । আমরা কখনো ছবির মত নিটোল সমাজ ভাবিইনি, এলোমেলো ব্যাঁকাত্যাড়া মার্জিনহীন সমাজেই থাকতে ভালবাসি । নতুন শতক আমাদের চিনিয়েছে সত্যের এক রুপ হয় না । সত্যের বিভিন্ন ডাইমেনশন থাকে । সমাজে গ্রাহ্য হয়,তুলে আনা হয় ক্ষমতাবানের ব্যাখ্যায়িত সত্য । তার মাধ্যম থাকে মিডিয়া ও দলবল । এখন প্রতি মুহূর্তে আমাদের মধ্যে আছড়ে পড়ছে একের পর এক শব্দ আর অডিও-ভিস্যুয়াল ক্লিপ । আমাদের ক্লিশে মনে হয় পারস্পরিক আলাপচারিতা । বাঙ্গালির পরনিন্দা, পরচর্চা ছিল ভূষন ।ক্ল্যাসিক পর্য্যায়ে চলে গিয়েছিল কলপাড়,শীতের দুপুরের ছাদ, স্কুলের অফ পিরিয়ডের সময় ,অফিসে সব জায়গায় । এখন মজাটা অন্য ভিডিও ক্লিপ্স এনে দিচ্ছে পরচর্চার খোরাক ফলতঃ পারস্পরিক ফিসফিসে আলচনায় নতুন কিছু উঠে আসছে না । সবই সোস্যাল মিডিয়া নির্ভর । প্রত্যেকে নতুন গল্প শুরু করার আগে জেনে যায় সেও দেখে নিয়েছে । প্রেমিক-প্রেমিকাও নতুন গল্প খুঁজে পায় না । বন্ধুত্ব ও তাই । ফলত ঃ বন্ধুরা একত্র হলেও বা প্রেমিক –প্রেমিকা একই সাথে দেখা হলেও দুটো কথার পরই বেছে নিজ নিজ তালুবন্দী সেলুলার । নিজস্ব অনুভূতি, ভাবনা পাব্লিক করে দেওয়ার তাড়নায় ভাইরাল করে দেওয়া হচ্ছে । কিন্তু কত চমক দিতে পারে এক মানুষ । জানানোর মধ্যে মুখচন্দ্রিকা আছে, নিজেকে মেলে ধরার মধ্যে যে গোপনীয়তা আছে তাকে এক ঝটকায় পণ্য,বেয়াব্রু করে দিচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ার দেওয়াল । কি খাচ্ছি,কি পড়ছি, আমার যোউথ নিবাসের দিন কবে শুরু হচ্ছে বা আমার সম্পর্কের মধ্যে কিভাবে দেওয়াল উঠছে – সব দেখে যাচ্ছি আঙুলের স্ক্রোল পারদর্শীতায় । এভাবে মানুষ বড়ো আকর্ষনহীন হয়ে পড়ছে ,রহস্যময়তা হারাচ্ছি আমরা । ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে । ইন্দ্রিয়ের স্পর্শ অনুভুতির মাঝে যে হিমোগ্লবিনের দৌড় শুরু হয় সেখানে টাচ স্ক্রিনের স্পর্শ আমাদের সেই অনুভব এনে দিতে পারে কিনা জানা নেই । এই মায়া-বাস্তবতার মধ্যে আমাদের আবেগ,অনুভূতি উজাড় হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ক্লান্ত করে যাচ্ছে ,আমাদের সময় চুরি যাচ্ছে, একাকিত্বের কংক্রীটে ধাক্কা খেয়ে আসছে আমাদের মন স্ফুরনের হাহাকার । আমরা ভুলে যাচ্ছি এক এক ছোঁয়ায়, এক আলিঙনে, স্বেদ বিন্দুর সমবায়ে জন্ম নিতে পারত যে কাব্যময় মানুষ । এইখানেও উঠে আসছে সেই শব্দছক মেলানোর প্রবণতা। মিথ্যা তথ্য সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে নিপুণ মেধায় । এ জন্য গড়ে উঠেছে সাইবার মিশন । লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য ক্ষমতার সত্য বাচন আমাদের কাছে ধ্রুব সত্য হয়ে উঠছে। সামগ্রিক দর্শন বিতর্কে অংশগ্রহন আমাকে সরিয়ে নিচ্ছে । এইভাবেই মনোজগতে জন্ম নিচ্ছে কাল্ট । ব্যক্তিগত চাদিদা, ব্যক্তিগত অনুভূতির চর্চা আমাকে এই মায়া সত্য সমাজে আমার অন্তঃকরণে জন্ম দিচ্ছে এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত । এই ‘ পোস্ট ট্রুথ ‘ আমাদের ঠিকিয়েছে বার বার । তখন প্রচারক ছিল এক ব্যক্তিত্ত্বময় মানুষ আর এখন সোস্যাল মিডিয়া । তবে এখন প্রতিস্পর্ধা শব্দ ছক ও উঠে আসছে । আমরা যারা সবসময় এই শব্দসমুদ্রে বাস করি । এখন বাক্যময়তায় নয় মুদ্রকময়তায় । একটি ছোট্ট যন্ত্র আমাদের তর্জনীকে নিয়ে যাবে সেই সত্যের কাছে যার পিছনে আছে প্রত্যেক মানুষের বিন্দু বিন্দু প্রতিদিনের শব্দ প্রক্ষেপের পিছনে চিন্তার আবরণী থাকে তার সুচারু বিশ্লেষনে সার্ভে রিপোর্টে সাইবার মেধায় সমাজের ট্রেন্ডকে ধরে ফেলা হয় তার সাথে ক্ষমতার স্বপ্ন মিশানো থাকে । এইভাবে আমরা যারা শব্দছক মেলানর খেলায় নিজেদের কাছে হেরে যাচ্ছি বার বার । সে মর্ডান হোক আর পোষ্ট মর্ডান । ক্ষমতার উৎসের ট্রিগার যার কাছে সেই সিকান্দার ।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register