Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৩৯)

maro news
ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৩৯)

কু ঝিক ঝিক দিন 

৩৯

পরীক্ষা চলাকালীন দিদা স্কুলে নিয়ে যেত।আমার সিট পড়েছিল হোলি চাইল্ড স্কুলে। পরীক্ষা শুরুর আগে সিস্টার প্রেয়ার করতেন।আর আমরা রামকৃষ্ণ শরণাম করতাম।এই প্রথম কোনো খ্রিস্টান স্কুলের ভিতর ঢুকলাম।আমাদের স্কুলও মিশন স্কুল।কিন্তু দুটোর সংস্কৃতি পুরো আলাদা। সিস্টার ক্লাসে এসে বলতেন,গড ব্লেস অল অফ ইউ। এই বিষয়টার মধ্যে একটা পজেটিভ ভাইভ ছিল যা মনকে শান্ত করে দিত। আমি যখন ঘাড় গুঁজে পরীক্ষার পাতায় পানিপথের যুদ্ধের কারণ কিংবা ভুগোলের ম্যাপে কোথায় কি লিখছি,তখন দিদা বাইরে গাড়িতে আমার অপেক্ষায় বসে। দিদাকে মা বলত, তুমি তো বাড়ি চলে এলেই পারো।পরে গাড়ি গিয়ে নিয়ে আসবে মনাকে। দিদা সে কথা কানেই দিত না।কখনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেত,কখনো আমার বন্ধুদের মা বাবার সঙ্গে গল্প করত। কাকিমারা মুগ্ধ হয়ে দিদার কথা শুনত।কখনো দেখতাম কোনও সিস্টারের সঙ্গেও গল্প করছে।আসলে দিদা গল্প করতে ভীষণ ভালো বাসত।যাকেই পেত তার সঙ্গেই গল্প জুড়ত। চায়ের দোকানের মালিক দিদাকে মা বলতে শুরু করল।ওই তিন ঘন্টায় দিদা অন্তত পাঁচ কাপ চা খেত,আর রোজ বেরিয়ে দেখতাম সে কিছুতেই টাকা নিচ্ছে না।পরীক্ষা শেষের দিন দিদা হেঁদোয়ার মুখের রোলের দোকান থেকে কয়েকটা রোল কিনে তার হাতে দিয়ে বলল,এগুলো আমার নাতি নাতনির জন্য। তার যে দুটি ছেলে মেয়ে সেটাও দিদা এই কদিনে জেনে গেছিল। পরীক্ষা শেষ হবার পর দিদা আমাকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি টেলি পাড়া লেন,টাউন স্কুলের গলিতে যেত।সেখানে দিদার মা মানে বড় দিদা আর দিদার বড় ভাইয়ের বউ অপেক্ষায় থাকত।মামী দিদা এত ভালো রান্না করত যে সেই খাবার খেয়ে পরীক্ষার ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। দিদা নিজে অবশ্য খালি একটু তরকারি টেস্ট করত।ভাত খেতো না। মামি দিদা লুচি ভেজে দিলে একটা খেত। আসলে দিদা সারাদিনে একবার মাত্র আতপ চালের ভাত খেত ঘি আর পোস্ত বাটা দিয়ে।বিধবাদের নাকি দু বার ভাত খেতে নেই! এই নিয়ে দিদার সঙ্গে আমার প্রায়ই বিবাদ হতো।আমি কোনোও দিন কোনও সংস্কার মানিনি।ছোটো থেকে একটা জিনিস বুঝেছি আমাদের চারপাশে যে সব নিয়ম কানুন বিধবাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা অযৌক্তিক। আজকের দিনে তার কোনও মানে নেই। সংস্কার সেটাই যা আমাদের ভালো শিক্ষা আয়ত্ত্ব করতে সাহায্য করবে। কিন্তু এত নিয়মের বেড়াজালে আর যাই হোক মন আনন্দে থাকতে পারে না। দিদা কিন্তু এ বিষয়ে একেবারে কঠোর ছিল।তার একটাই বক্তব্য -যে মানুষটা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে বিয়ে করল,এত যত্নে রাখল,তার জন্য আমি এটুকু না করলে নরকেও ঠাঁই হবে না আমার। সেই নরক,সেই স্বর্গ যা দিয়ে আজন্ম মানুষকে ভুলিয়ে রাখে একদল পুরোহিত, যাদের দোসর ব্রাক্ষণ সমাজ। দিদাকে একথা বললেই ক্ষেপে যেত।তুই কি রে?নিজে ব্রাক্ষণের মেয়ে।রামকৃষ্ণকে গুরু মানিস।তোর মুখে কি সব ধর্ম নিয়ে ছেলেমানুষী কথা বার্তা!পাপ হবে যে! আমি তখন আরও জোরে রামকৃষ্ণ কিংবা বিবেকানন্দ আউরাতাম। আমার কাছে পাপ বলতে ন্যায়ত কোনও মানুষের ক্ষতি না করাকেই বোঝায়।আর আমি বিশ্বাস করতাম,আমার দ্বারা কোনও ক্ষতি কারোর হবে না। ক্লাসে ফোরে আমার ভীষণ ভালো বন্ধু বুলবুলির নামে একটা নালিশ করেছিলাম স্কুলের শোভাদির কাছে।বুলবুল বকা খাবার পর তার মুখটা লাল হয়ে গেছিল।সত্যি সে পরীক্ষা দিয়েছিল টুকে। কিন্তু বকা খাবার পর আমার মনে হয়েছিল, আমি ঠিক করিনি।ওর ওই মুখটা বহুদিন আমাকে তাড়া করে ফিরত।কি দরকার ছিল ওর নামে বলার!আমি নিজে বারণ করতে পারতাম,তা না করে সরাসরি ক্লাস টিচারকে কেন বললাম! মা'ও আমাকে বকেছিল।বলেছিল,তুমি অন্যায় করেছ।যদি সত্যি ও তোমার প্রিয় বন্ধু হয় তবে আগে তোমারই নিষেধ করা উচিত ছিল।তারপর না শুনলে তখন বলতে। বুলবুল আমার সঙ্গে তারপর থেকে কদিন কথা বলেনি।আমার নিজেরও ওকে দেখলে ভয়ংকর অপরাধবোধ কাজ করত। এরপর বুলবুল বহুদিন স্কুলে এল না।আমি তার বাড়িতেও গেলাম।দেখলাম তালা বন্ধ। একদিন সে এল আমার বাড়িতে দেখা করতে।বলল,ওরা চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। তাই যাবার আগে দেখা করতে এসেছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম।ক্ষমা চাইলাম সেদিনের ঘটনার জন্য। ও আমাকে অবাক করে বলল,দূর,আমি তো সত্যি টুকছিলাম।তার জন্য তুই মন খারাপ করছিস কেন? না বলে দিলে অন্য সাবজেক্ট গুলোও টুকতাম।বরং বকা খেয়ে বাকিগুলো পড়লাম। বুলবুল চলে গেল।আমি দীর্ঘদিন ভেবেছি ও আমার জন্যই স্কুল ছেড়ে ওর বাবার কাছে চলে গেল।ওর বাবার বদলীর চাকরী। এই একটা ঘটনা আমাকে অনেক বদলে দিয়েছিল।আর কখনো কোনও বন্ধুর বিরুদ্ধে কাউকে অভিযোগ করিনি।ওটাই আমার মনে হয়েছিল আমি পাপ করেছি।তাই বুলবুল চলে গেল। আর কখনো বুলবুলের সঙ্গে দেখা হয়নি। দিদার কথাগুলো শুনে হয়তো তাই ভিতরে ভিতরে রাগ হত। দিদা দুদিন অন্তর বাজার করতে যেত আমাকে বা রম্যানিকে নিয়ে। বাজার করার পর দোকানদার একটা রিকশা ডেকে দিত। সবার কাছেই জনপ্রিয় দিদা।কিছু দিন হয়তো আসেনি কলকাতায়, যার সঙ্গেই দেখা হত, জানতে চাইত- তোর দিদা কেমন আছেন?কবে আসবেন?আমার প্রণাম জানাস। দিদার সঙ্গে তাদের কখন যেন এক নিরবিচ্ছিন্ন সুখ দুঃখের বন্ধন তৈরি হয়ে গেছিল। সবার খুঁটিনাটি বিষয়ও দিদা জানত।যখন আমাদের চিঠি লিখত ফিরে গিয়ে প্রত্যেকের খবর নিত,আর তাদের জন্যও দু ছত্র করে লিখত। তারাও আবার চিঠি দিত। এভাবেই একজন অচেনা মানুষ কখন আপন হয়ে যায় তা দিদার থেকে শেখা। দিদা বলত,তোর দাদু কতবার যে মহিলাদের হাতে মার খেতে খেতে বেঁচে গেছে আমার কারণে তার ইয়ত্তা নেই। কেন?দাদু কি করত? কি আবার!টিকিট পরীক্ষা করার সময় মেয়েদের গলার হারের ডিজাইন, হাতের বালার ডিজাইন এসব দেখত।আর খোঁজ নিত কোন দোকানে সেগুলো বানানো হয়েছে। তারপর আমাকে সেই জিনিস বানিয়ে দিত। সোনার? হ্যাঁ, সোনা নয় তো কি! তুমি তো কখনো পরো না? তিনটে মেয়ে তিনটে ছেলের বিয়ে দিয়েছি।সব দিয়ে দিয়েছি তাদেরকে। এখন কি আর বয়স আছে সে সব পরার? আমি অবাক হয়ে ভাবতাম আমার দাদু দিদাকে এত ভালেবাসত! আমার সেই অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে দিদা বলত,আমার ঈশ্বর তোর দাদুই। আমার তখন হাসি পেত।অথচ জানতাম,দিদা মন থেকে যা বিশ্বাস করে তাই বলছে। আমার আজন্ম সাদা শাড়ি পরা দিদাকে মনে হত কত বুড়ি! দাদু চলে যাবার পর সাদা থান, তার আগেও চওড়া পাড় সাদা শাড়ি দেখতে দেখতে ভাবতাম দিদারা বুঝি এমনই বুড়ি হয়!আর বয়স হলে সাদা শাড়িই পরতে হয় মেয়েদের। অথচ কখনো ভেবেও দেখিনি দিদার বয়স তখন খুব বেশি হলে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। আমার কালো চুল সাদা শাড়ি পরা নিরাভরণ দিদার গায়ের গন্ধ কখন যেন কদম্ব ফুলের গন্ধ হয়ে এক বর্ষার রাতে মিলে মিশে গেল। তারপর কত বৃষ্টি নামলো শহরে,জলে টইটুম্বুর হয়ে গেল সিঁথির অলি গলি।সেই জল পেড়িয়ে দিদার কাছে আর পৌঁছাতে পারলাম না। শুধু কদম্ব ফুলের গন্ধ ভেসে এলে বা বেলিফুলের মালা খোঁপায় জড়ালে মনে পড়ে যায় দিদা আছে।হয়তো কাছে কিংবা দূরে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register