Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে গদ্যে পূর্বা দাস

maro news
ক্যাফে গদ্যে পূর্বা দাস

নিঃশব্দ হাভেলি

ভেবেছিলাম প্রশস্ত নিরাপদ রাজসড়ক ধরেই তরতরিয়ে এগোন যাবে। কিন্তু কলমটি অবাধ্য। বশে থাকে না সবসময়। তাই রাজপথ ছেড়ে তস্য গলি, তারপরেও বালি কাঁকরে ভরা মেঠোপথে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়েছি। হ্যা। এক্কেবারেই মেঠোপথ। দশেরা ময়দানের পর অনেকগুলো তাবু আর তাবুর পাশে বাঁধা পাঁজরসর্বস্ব ঘোড়া দেখে `বানজারা বানজারা' বলে চেঁচিয়ে উঠতে ধমক খেলাম রমজানীর কাছে। আরে, ওরা ঢোলওয়ালা। বিয়ে শাদীতে ঢোল বাজায়। ঘোড়ার নাচ দেখায়। সত্যিই রাবণহাত্তা বাজিয়ে গান গাইছিল একজন। মাথার চেয়ে পাগড়ীটা অনেক বড়। রুকু বলল, বানজারা কলোনী একটু দূরে। এখন আর ওরা বানজারা না। লোহার। হাতুড়ি, খন্তা বানায়। হতে পারে। ওদের বেদুইন রক্তে হয়তো মাটির টান পড়েছে। নয়াপুরা ছাড়িয়ে, বাদিকে থার্মাল পাওয়ার স্টেশন রেখে ঢুকে গেলাম নানতা গ্রামে। সে কি রাস্তা, বাপরে!
কিন্তু এই দূর্গম গিরি-প্রান্তর মরু পেরিয়ে চলেছি কোথায়! কি, না- রোগাভোগা, হাড় হাভাতে এক মহলের খোঁজে। আভেড়া মহল। মাস দেড়েক আগে এক ভরাবর্ষার দিনে চুপচুপে ভিজেছিলাম এখানে এসে। তখনই দেখেছিলাম, মহলের ভেতরে তালাব এ গোটাকয় পদ্মের কুঁড়ি এসেছে। সেই থেকে তক্কে তক্কে আছি বৃষ্টি কমলেই যাবো পদ্মবিল দেখতে। তালাব কিন্তু বহু পুরোন। ইতিহাস বলছে, 1346 AD তে বুন্দির রাজা ধীরদেও প্রতিষ্ঠা করেন এই তালাব। তখনও কোটা আলাদা রাজ্যের মান পায়নি। এই অঞ্চল তখন গভীর জঙ্গল; শ্বাপদ এবং উপজাতি অধ্যুষিত। মহারাজা ধীরদেও কিছুটা জঙ্গল পরিস্কার করে তালাবটি রেখেছিলেন এখানে। কেন - কেজানে! অনেক পরে সম্ভবত 18th century তে ছোট্ট মহল তৈরী হয়েছিল তালাব এর কিনারা ঘেঁষে। কোটার মহারাজা উম্মেদ সিং ( দ্বিতীয়) কুমীর পুষেছিলেন তালাব এ। রাজারাজরার ব্যাপার। আর অদ্ভুত! কুমীরগুলো নিজেদের নাম অবধি জানত। চৌকিদারের ডাকে ওরা জল থেকে উঠে রাজদর্শণ করতে আসত। মহলতো নামেই। ঘর দুয়ার কই! শুধুই চওড়া দালানের মত কঠঘড়া। কাঠের নয়, পাথড়ের; এই যা। আধ মানুষ উঁচু একেকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলা অবধি উঠেও মনুষ্য বাসযোগ্যতার চিহ্ন পেলাম না। তবে কেন এই মহল! সম্ভবত প্রমোদ-শিকার খেলা দেখবার জন্য তৈরী হয়েছিল। নাহলে চারদিক খোলা দিগন্তদিশারী এই হঠাত্ স্হাপনটির আর কোন মানে হয় না। ভেতরে সুন্দর পরিকল্পিত বাগিচায় আম, জাম, কমলালেবুর গাছ প্রচুর ছিল। এখনও কিছু আছে। নতুন ধরনের গাছও বেড়েছে আদরে। মহলের দায়িত্ব ASI এর হাতে থাকায় যত্নআত্যির অভাব হচ্ছে না, বোঝা গেল। ঐতিহাসিক ফিরোজ আহমেদ এর ভাষ্যে, মুঘলশৈলীতে তৈরী হয়েছিল এই বাগিচা। অনেকটা পাথুড়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে সবুজের সমারোহে চোখ জুড়িয়ে দিল। ভেতরে আবার ছোট চিলড্রেনস পার্ক হয়েছে। বোটিং এর বন্দোবস্ত আছে। আমি অবশ্য ঘেঁষিনি সেদিকে। একে সাঁতার জানিনা, তার ওপর মগরমাছ নাকি এখনও আছে দু একটা।
বেলা দশটায় শরতের রোদ্দুর বেশ চড়া। হিন্দু, জৈন, ইসলামিক স্হাপত্যের মিশেলে তৈরী আভেড়া মহলের ঝড়োখাতে চোখ রেখে দূরের ছোট ছোট ঘরবাড়ী দেখতে দেখতে ঝাপসা হল দৃষ্টি। বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম, মুকনদরা পাহাড়শ্রেণী থেকে নেমে আসা ঘন জঙ্গল ঘিরে রেখেছে মহলকে চারপাশ থেকে। অজস্র ময়ুর, বুলবুলির ঝাঁক বসে আছে, উড়ে বেড়াচ্ছে বাগিচায়। দূর থেকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে চিতল হরিণের দল। জঙ্গলের রাজা গন্ধ শুঁকে বুঝে নিচ্ছে, আজও কি ঐ অদ্ভুত জন্তুগুলো তাদের এই শান্তির জীবন, নিয়মের জীবনেকে তছনছ করতে আসবে! বড্ড ধূর্ত ঐ দু পেয়ে জাত। কোন রীতিনীতি মানে না। অযথা, অকারনে হত্যা করে, শুধু লোভের ঝুলি ভরাতে। জঙ্গল ছোট হয়ে আসছে। কালি, আহু, রমজান - সব নদীতেই জল কমছে ক্রমশঃ। এক চম্বলই এখনও দূর্ধর্ষগামিনী। অতীতের চীর অধ্যায়কে একলাফে পেরিয়ে চোখ ফেরাই আরো ভবিষ্যতের দিকে। দেখতে পাই, নতুন, আরো নতুনতরো শিল্পের অধিগ্রহণে আরো ক্ষীণ হয়েছে সবুজের সীমানা। ঝর্ণা, নদীরা মুখ লুকিয়েছে পাথড়ে। অপরিমিত নির্মাণেরা ঘিরেছে অঞ্চল। কমলবন শূন্য। পাখিরাও আসে না। আভেড়া মহল শুধু অস্তিত্বটুকু সম্বল করে দাঁড়িয়ে আছে, আরো বহুযুগ ধরে - ভেন্টিলেশনে।\
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register