Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব - ১২)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব - ১২)

তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন

১৯
রতন বললো, এগুলো সব জানলেন কি করে? আপনাকে প্রণাম।
পিসেমশায় বললেন, এর জন্য বিভিন্ন বই পড়তে হয়। মোবাইলে টিকটক আর ভিগো না দেখে গুগুলে সার্চ করলে অনেক পন্ডিতের লেখা থেকে এইসব জানতে পারবে শিখতে পারবে বিশদে। আমি তো সামান্য কটা কথা বললাম।
অঘোরীরা পূজা করে শিবের। এছাড়াও মৃত্যুর দেবী কালীসাধনাও করে থাকে এরা। বারানসীর অঘোরী মেরোনাথ এক সাক্ষাৎকারে ফটোগ্রাফার এবং লেখক ডাভোর রস্তুহারকে বলেন, “হিন্দুবাদে প্রত্যেকটি প্রভুর একটিমাত্র রুপ থাকে। বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করে। তাদের মতো করে নৈবেদ্য প্রদান করে। শিব আর মা কালী যখন ভক্তদের কাছ থেকে বলী আশা করে, তখন ভক্তরা কিন্তু তা মান্য করতে নিরুৎসাহিতা দেখিয়ে থাকে। আমরাই একমাত্র গোত্র, যারা মা কালী এবং শিবের আশামতো নৈবেদ্য প্রদান করে থাকি।” পিসেমশাই বললেন, আর এক ধরণের তান্ত্রিকের নাম আছে। শিবরাত্রি পশুপতিনাথের মন্দিরে পৌঁছে গেলেই সাক্ষাৎ হয়ে যাবে অঘোরী সাধুদের সঙ্গে। দুর্গম পাহাড় থেকে এরা একে একে বেরিয়ে আসেন শিব পুজোর জন্য। অঘোরী বলতে মূলত বীভত্‍স আচারে অভ্যস্ত শৈব সম্প্রদায়কে বোঝায় যাঁরা মহাকালের তপস্যায় গভীরভাবে বুঁদ হয়ে আছেন। অঘোরীদের সাধন পদ্ধতি যেমন ভয়ানক তেমনই এরা প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। এরা বৃষ্টি বা খরার আহ্বান করতে পারেন যখন ইচ্ছে। ইচ্ছে মতো বদলে দিতে পারেন ঋতুচক্রও। আজও মণিকর্ণিকার ঘাটে অঘোরীদের দর্শন পেতে পারেন আপনিও। যদিও প্রবল শীতের সময় ছাড়া বছরের বাকি সময় হিমালয়ের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন এরা। এদের উপাসনা পদ্ধতিও খুব অদ্ভুত। মল, মূত্র, পশুর মাংস, মানুষের মাংস, মদ সবই কাজে লাগে এই ধরনের তপস্যায়।এরা নোংরা, আবর্জনা থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে ইতস্তত করে না। অস্বাভাবিক খাওয়া দাওয়াই নয়, এরা মৃত দেহের সঙ্গে সাধনার জন্য যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এরা মৃতদেহ থেকে একধরনের তেল বের করেন যা দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ। টানা ১২ বছর কঠোর সাধনার পর অঘোরী গুরুর আশীর্বাদে নিজের ধর্মীয় যাত্রা শুরু করেন অঘোরী সাধুরা। আর তখনই জন্ম হয় এক চরম সাধকের। যাঁদের বস্ত্র হয় মৃত ব্যক্তির জামা-কাপড়ের ছেঁড়া অংশ। শরীরে থাকে মৃত দেহের ছাই। এখানেই শেষ নয়, এমন সাধকদের সারা জীবন একজন গুরুর অধিনে থাকতে হয়। প্রত্যেক অঘোরী সাধু কে একজন গুরুর অধীনে থাকতে হয়। গুরু যা বলেন, সেইভাবে জীবনযাপন করতে হয়। সংগ্রহ করতে হয় মৃতদেহের খুলি, যা তাঁদের সাধনার প্রধান উপকরণ। এরা মন্ত্রোচারণ করতে শুরু করলে শরীরে একজন মানুষকে গায়েও করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আমি বললাম, পৃথবীর কতটুকু আমরা জানি। পিসেমশাই বললেন, খুব সামন্য অংশ।
রতন বললো, সামান্যই ব বললেন, শ্মশানে শবের উপর বসে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। মহাদেব হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহে তিনিই একক রূপে ঘোষিত। শিব সৃষ্টি-স্থিতি ধ্বংসরূপে তিন কারণের কারণ, পরমেশ্বর- এটা তার প্রণাম মন্ত্রেই বার বার উঠে এসেছে। তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ; তিনি স্ব-স্বরূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি; তিনি তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন।শিব ও শঙ্কর এই দুটি সবচেয়ে বেশি করে হিন্দু সমাজে ঘোরাফেরা করে। বিশেষ করে যারা ধর্মীয় ভাবাবেগকে দর্শন করে ঈশ্বর কল্পনায় মূর্ত হন তাদের কাছে শিব ও শঙ্কর নাম দুটি নিয়ে প্রবল ধাঁধা রয়ে গিয়েছে। মা কালি, মা তারা, ভবতারিণী সব এক শক্তি বাবা। ভিন্ন নামে তারা পরিচিত।
২০
আমি বললাম তান্ত্রিক সাধকরা বেশিরভাগ মা কালির সাধনা করেন জানি। পিসেমশাই বললেন , মা কালি ও শিব ও শঙ্কর নামে আদল বা ধারণা পাওয়া যায় তিনি হলেন শিব।এঁরা আলাদা কেউ নন। ঈশ্বরের থেকেই উৎপত্তি সব শক্তির। ধ্বংসের প্রয়োজনে এবং অত্যাচার নিরসনে বাবা মহাদেব শক্তিরূপিণী মা কালির রূপ তৈরি করেন। আবার শক্তি বিলীন হন তাঁর মধ্যে। । শিবপুরাণ এবং অন্যটি হল শৈবাগম শাস্ত্র পড়লে এসব জানা যায়। শিব নামটি-র সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিবলিঙ্গের কথা। অন্যদিকে শঙ্কর নামটি হল ভগবানরূপে কল্পিত শিব-এর মানবরূপী পরিচয়। সুক্ষ্মদেহ স ম্পন্ন এক সত্তা। তধ্যানরূপেণ পূজিতর্ধচন্দ্র, কন্ঠে সর্পাহার এবং জটায় গঙ্গাকে ধারণ করেছেন। শঙ্করেরর মূর্তিকল্পে যে যে বিষয়গুলির উপরে নজর দিতে হয় সেগুলি হল অর্ধচন্দ্র, যা মাথার জটার মধ্যে থাকে। এর অর্থ হল জ্ঞানের প্রতীক। হাতে থাকে ডমরু। এর অর্থ হল অদ্বৈত। গলায় থাকে সাপের কুন্ডল। এর মানে এটি হল কুলকুন্ডলিনীর প্রতীক। ত্রিশূল কখনও ত্রিগুণ, কখনও ত্রিকাল, কখনও বা সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের যে তিন তত্ত্ব আছে তাকে ব্যাখ্যা করে। গঙ্গা বিশুদ্ধতার প্রতীক। যা বিশুদ্ধ জ্ঞানকে সংযোগ করে। তৃতীয় নয়ন মানে হল ত্রিকাল দর্শন।
দুই পুরাণ গ্রন্থে এমন কাহিনিও রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে শিব ব্রক্ষ্মার মাধ্যমে সত্যযুগের সৃষ্টি করেছিলেন। এবং শঙ্কর-কে তিনি মানবরূপে নিয়ে এসেছিলেন কলিযুগে যাতে তিনি সৃষ্টি-কে সংহার করতে পারেন। তাই শিব ও শঙ্কর এক হলেও দুজনের নামের পিছনে রয়েছে দুই বিশেষ কাহিনি। তাই বলা হয় শিব হল দৈব্যভাবের প্রতীক। আর শঙ্কর মানে আদি ও বিমূর্ত রূপকেই বোঝায়। কিছু কিছু সামাজিক নিয়ম থাকে যা একটা সময়ের পর অগ্রাহ্য করলে কোন অসুবিধা হয় না। স্পষ্ট বোঝা যায় যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে, সেগুলো না মানলে তেমন কোন সমস্যা নেই। নারীদের শ্মশানে যাওয়া নিষেধ সংক্রান্ত যে সব কারণ রয়েছে, সেগুলোও তাই বর্তমান শহুরে সমাজে চলে গেছে অগ্রাহ্যের খাতে।
তবে, অনেক অঞ্চলে এখনও কঠোরভাবে মেনে চলা হয় নারীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ না দেওয়ার নেপথ্য কারণগুলো! যার শুরুটা হয়েছিল রক্ষণশীলতার হাত ধরে।
বর্তমান সময়ে শবদেহ বহন করার জন্য গাড়ি পাওয়া গেলেও বছর কয়েক আগে পর্যন্ত শ্মশানবন্ধুরা দেহ নিয়ে যেতেন কাঁধে করে। পথ দিয়ে মিছিল করে তারা পৌঁছতেন শ্মশানে। এটাই ছিল শবদাহের প্রথম ধাপ। শেষ সময়ে পাওয়া পরিজনের শেষ সেবা। কিন্তু রক্ষণশীলতা নারীকে পথে বেরনোর অনুমতি দেয় না। দিলেও, মিছিলে হাঁটার প্রশ্নই নেই। সেই জন্যই মূলত নারীর শ্মশানে যাওয়া নিষেধ করা হয়।
তবে, এই সামাজিক প্রসঙ্গ বাদ দিলেও দেখানো হয় আরও পাঁচটি যুক্তি। তার মধ্যে কোনটা অমোঘ, কোনটা আংশিক সত্যি, কয়েকটা আদ্যন্ত অর্থহীন। কী কী, এবার এগোনো যাক সেই দিকে।
ঘর পরিষ্কার রাখা: এই কারণটা অনেকটাই যুক্তিযুক্ত। দেহ অন্ত্যেষ্টির জন্য শ্মশানের দিকে চলে গেলে ঘর পরিষ্কার করাটা একটা বেশ বড়সড় কাজ। কেন না, মৃতদেহ থেকে জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে। তাই ঘর-দোর ভাল ভাবে ধুয়ে-মুছতে হয়। এখন, এই ঘর পরিষ্কার রাখা, বলাই বাহুল্য, বরাবরই থেকে গেছে নারীদের খাতে। সেই জন্যই তাঁরা শ্মশানে যান না। বাড়ি পরিষ্কার করে যতটা সম্ভব দূর করে দিতে চান শোকের আবহ। তাছাড়া, হিন্দু অন্ত্যেষ্টি প্রথা অনুসারে শ্মশানযাত্রীরা বাড়ি ফিরলে তাদের দিকে এগিয়ে দিতে হয় লোহা-আগুন-নিমপাতা। শ্মশানবন্ধুদের আপ্যায়ন করতে হয় মিষ্টি দিয়ে। সেই সব কাজের জন্যও বাড়িতে কারও একটা থাকা দরকার!
শ্মশানের ভীতিকর পারিপার্শ্বিক: বলাই বাহুল্য, শ্মশানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য আদপেই মধুর হয় না। বরং, তা রীতিমতো ভয়াবহ। একের পর এক দাহের অপেক্ষায় থাকা দেহ, মৃতের পরিজনের কান্না, শোকাতুর মুখ, ডোম আর শ্মশান-পুরোহিতের দেহ সৎকারের নির্লিপ্তি- চোখের সামনে দেখা খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে যার প্রিয়জন দেহত্যাগ করেছেন, তার পক্ষে তো বটেই! এই জায়গা থেকেই নিষেধ করা হয়ে নারীদের শ্মশানে যাওয়া! আসলে, সবাই ধরে নেন, নারীরা মাত্রেই কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী। শ্মশানের ভয়াবহতা দেখে যদি সংবেনশীল মনে আঘাত লাগে, যদি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন- এসব ভাবনা-চিন্তা থেকেই জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া আরও একটা গুরুতর কারণ রয়েছে। যে সময় থেকে এই নিয়মের প্রচলন, তখন দাহ হত কাঠের চিতায়। অনেক সময়েই চিতায় দাহর সময় শব আগুনের উত্তাপে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কখনও বা উত্তাপে দেহ উঠে যায় কিছুটা। ঠিক যেন মনে হয়, শব চিতায় উঠে বসেছে। সেই সময় বাঁশের আঘাতে টুকরো করে দিতে হয় মৃতদেহ। এই দৃশ্য পুরুষদের পক্ষেও সহ্য করা কঠিন! নারীদের পক্ষে তো হবেই!

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register