"কিন্ত... রুকসানা কে আমরা খুঁজবো কোথায় বলতো??!! আমরা নিজেরাই তো এখনো এই জায়গাটার সেরকম কিছুই চিনিনা রে স্রোত...."
"চিনি না বললে তো হবে না রে সুজী...চিনে নিতে হবেই...যে করেই হোক, রুকসানা কে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে... ভোরের আলো ফোটার আগেই...আর কেউ টের পাওয়ার আগেই"
"আমার একটা প্ল্যান আছে...." সমীর বললো... " আমরা আলাদা আলাদা দল করে সব দিকে ছড়িয়ে গিয়ে খুঁজবো..."
" সমীর ঠিকই বলেছে...তাহলে কোনো জায়গাই না খোঁজা থাকবে না "
"ওক্কে... তাহলে সমীর আর রিজ্ একদিকে যা...প্যাম,ডাইকো,সুজী একদিকে যা.…. আমি আর মিট্টি আর একদিকে...."
"আর একটা দিক??"
"ঐ তিন দিকে খুঁজে না পেলে...তখন আমরা নিশ্চিত হয়ে যাবো যে ও আর একটা দিকেই আছে...আর আমরা সবাই মিলে সেদিকেই যাবো তখন..."
"আমি একটা খুব জরুরি কথা বলবো তার আগে তোদের.." ডাইকো চিন্তিত মুখে বলে উঠলো... তোদের জানা উচিত..এই ইসপ্যামা কিন্তু সাঙ্ঘাতিক জায়গা.. আমার গ্যাগ্যা আমাকে সব বলে রেখেছেন... উনি বলেছেন...এখানে অনেক ম্যাজিকাল আর নিষিদ্ধ জায়গা আছে...যেসব জায়গায় অনেক প্রফেসররাও যেতে ভয় পান... আসলে ইসপ্যামা বিশাল জায়গা...একটা পুরো শহরের যতটা আয়তন...এর বাউন্ডারি ততটাই বড়...এর অনেক জায়গাই কিন্তু সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক...আর সবথেকে ভয়ঙ্কর হচ্ছে এর দক্ষিণ দিক টা.... সে ব্যাপারে তোদের পরে কোনোদিন ভালো করে বলবো...."
"কিন্তু সাউথের দিকে তো আমি আর প্যাম...কাল অনেকটা হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম... একটা বিশাল গলফ্ খেলার মতো ,সবুজ ঘাসে ঢাকা ঢেউ খেলানো মাঠ...আর বিশাল বড় বড় গাছ আছে... জায়গাটা তো এত সুন্দর... যে আর আসতেই ইচ্ছে করে না..."
"সব সুন্দর জিনিস ভালো বা নিরাপদ হয় না সুজী...ঐ মাঠের প্রত্যেকটা অংশ রহস্যময়....ম্যাজিকাল...আর ঐ বিশাল মাঠের শেষ প্রান্তে আছে ইসপ্যামার মিউজিয়াম... সেখানে যুগ যুগ ধরে যে কত ভয়ঙ্কর, নিষিদ্ধ সাংঘাতিক জিনিস রাখা আছে..."
"ঠিক আছে ডাইকো...ইসপ্যামার হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি তোর থেকে পরের ক্লাসে শুনে নেবো... কিন্তু এখন আমাদের কথা কম কাজ বেশি করে আগে বেরোতে হবে... আশা করি রুকসানা বেশি দূর যেতে পারেনি...অচেনা জায়গা...ঐ টুকু বাচ্ছা...আর কতদূর ই বা যাবে... কিন্তু তুই যা বললি...যদি দক্ষিণের ঐ মাঠের দিকে যায়....বাচ্ছা তো...হয়তো মাঠ দেখে খেলতে ইচ্ছে...."
মিট্টির কথা শেষ হতে না হতেই রিজ্ ডুকরে কেঁদে উঠলো...
"আমার সানা....ও হো হো... আমি এখন কি করবো...ও যে কিছু খায়ও নি.."
আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম..
"এখন কাঁদার সময় নয় রিজ্... চলো সবাই...আমরা দুটো দলে ভাগ হয়েই দুটো করে দিক কভার করবো..."
"দাঁড়া...এত কিছু করতে হবে না...সবাই একসাথেই ওকে খুঁজবো...যদিও....যদিও..মেন্টর যতক্ষণ না অর্ডার দিচ্ছে... ইসপ্যামাতে পাওয়ার ইউজ্ করা বারণ...কোনো প্রফেসর জানতে পারলে পানিশমেন্ট পেতে হতে পারে... কিন্তু এই ক্ষেত্রে কিছু করার নেই... রুকসানাকে আগে পেতেই হবে...আর ও কোথায় আছে... আমি খুব সহজেই খুঁজে পেতে পারি..."
"মানে!!! সিরিয়াসলি ডাইকো...
তাহলে এতক্ষণ জ্ঞান না দিয়ে সেটাই তো করতে পারতি..." প্যামের গলায় রাগ স্পষ্ট..."
"কিন্তু কী ভাবে করবি সেটা ডাইকো??"
"দ্যাখ সমীর.... আমি আসলে কী??
"তুই নেকড়ে.." মিট্টির চটপট উত্তর
"হ্যাঁ... আমি হচ্ছি ওয়্যারউলফ্ বা লাইক্যানথ্রোপ.... আমার ঘ্রাণশক্তি সাধারণ মানুষের থেকে দশহাজার গুণ বেশি... আমি রুকসানার ব্যাবহার করা কোনো জিনিসের গন্ধ একবার শুঁকে নিলেই..ও কোথায় আছে...স্মেল পেয়ে যাবো...আর আমরা সবাই সেখানে পৌঁছে যাবো..."
"ইয়য়য়য়ে.. থ্রী চিয়ার্স ফর ডাইকো দ্য নেকড়ে...."
"কিন্তু তুই আবার তোর সেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবি না তো??" প্যামের গলায় স্পষ্ট ভয়..."
"তাহলে তোর মাথার কেলে কেলে সাপ গুলো দিয়ে আমাকে ছোবল মেরে দিস ইয়ার..." ডাইকোর সাথে আমরাও হাসিতে যোগ দিলাম...
"রিজ....আমাকে একটু বল্ তো রুকসানা...ঐ বিছানাটায় শুয়ে ছিল...তাই না??"..
ডাইকো বিশাল কিংসাইজ খাটটার দিকে এগিয়ে গিয়ে...হাঁটু মুড়ে বসে...সাটিনের বেডকভারটায় নাক ঠেকালো....আর একটু পরে যখন উঠে দাঁড়ালো...আমরা দেখলাম...ওর চোখের মণি বা আইবল দুটো টকটকে লাল....
প্যাম সিঁটিয়ে উঠে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো...
"আমাকে ফলো কর তোরা...." বলতে বলতেই ডাইকো দ্রুতগতিতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল...আমরাও সবাই ওর পিছনে দৌড়লাম....
"ও তো সাউথের দিকেই যাচ্ছে রে....তার মানে কি রুকসানা ঐ দিকেই..."
মিট্টির আশংকা আমাদের সবার মনকে ছুঁয়ে গেল...রিজের জোরে নিঃশ্বাস টানার শব্দ ভেসে এল..ও কান্না চাপার চেষ্টা করছে....
ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই...তাই হয়তো ইসপ্যামার সাজানো গোছানো পথঘাট ফাঁকা হা হা ....চতুর্দিকে বড় বড় আর্কিটেকচারাল স্তম্ভে লাগানো
সাজানো আবার কিছু কিছু জায়গায় কায়দা করে লুকোনো আলোগুলোও খানিকটা ম্রিয়মান হয়ে এসেছে... এক ঝলক শেষরাতের ঠান্ডা হাওয়া আমাদের কাঁপিয়ে দিয়ে বয়ে গেল... আশপাশের বড় বড় সাজানো সুন্দর কাসল্গুলো... কটেজগুলো সব নিস্তব্ধ...যেন আমরা সেই ফেয়ারি টেলের স্লিপিং বিউটি র রাজত্বে এসে পড়েছি...ডাইকো রঙচঙে নুড়ি ভরা সাজানো রাস্তা ধরে এত দ্রুত ছুটছিল..আমরা তাল রাখতে পারছিলাম না...একসময় আমাদের বাঁ-দিকে এক বিশাল মহাকালীর মূর্তি দেখতে পেলাম....কি বিশাল অপূর্ব জীবন্ত...কালো রঙের আলো ঠিকরানো পাথরে গড়া... এলোমেলো মেঘের মত চুল হাওয়ায় উড়ছে....এক হাতে কোয়েশ্চেন মার্কের মতো (পরে জেনেছিলাম ঐ ওয়েপন টাকে খাঁড়া বলে) একটা অস্ত্র ধরা.....আর এক হাতে মানুষের স্কালের মধ্যে থেকে কিছু চুমুক দিয়ে খাচ্ছেন.... কিন্তু জীবন্ত চোখ দুটোতে প্রথম দিন যেমন দেখেছিলাম.... সেরকমই দুষ্টু মিষ্টি এক হাসি...যেন আমাদের কান্ড দেখে খুব মজা পাচ্ছেন... আমি মূর্তি টার পায়ের বেদীর কাছে থেমে গেলাম....মনে মনে কথা বলে উঠলাম
"খুব দুষ্টু আছো তুমি কিন্তু.....দেখো বাপু... আমাদের ছোট্ট বোনটাকে যেন ঠিকমতো খুঁজে পাই..."
" মহাকালীর মূর্তি রে স্রোত... মানুষের মাথার খুলি থেকে রক্ত খাচ্ছে দেখ্ ....ঠিক আমাদের মতো...না রে??"
মিট্টির গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম... ততক্ষণে ওরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে...আমরা দুজনও দৌড় দিলাম...
বেশ খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ যেন সমস্ত কাসল্, কটেজ, ক্লাস বিল্ডিং... ইত্যাদি পার্থিব অস্তিত্ব মুছে গেল...আর আমরা নিজেদের এক সবুজ ঘাসে মোড়া... মালভূমির মতো ঢেউ খেলানো আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মতো বিশাল ভূখন্ডের সামনে আবিষ্কার করলাম...আর তার সামনে 'এন্ট্রি স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড' বোর্ডটাও দেখে না দেখার ভান করলাম...ও সব দেখলে এখন চলবে না
"দেখ্ আমরা কতটা চলে এলাম... এখনো সানার কোনো চিহ্ন নেই....ও কি অন্য দিকে গেছে তাহলে ??" রিজের স্বর কান্না চাপতে গিয়ে বিকৃত হয়ে কেঁপে গেল...
"হতেই পারেনা....ডাইকো কখনো ভুল করতেই পারে না..." বলতে বলতেই দেখতে পেলাম ডাইকো হাঁটু অবধি ডুবে যাওয়া সবুজ....নরম ঘাস মাড়িয়ে...না থেমে এগিয়ে চলেছে....আমরাও ওকে অনুসরণ করলাম...কিছুদূর যাওয়ার পরই ঘাস জমির আশেপাশে বিশাল বিশাল পাতায় ঝুপসি হয়ে থাকা বহু পুরোনো গাছের জঙ্গল শুরু হোলো.... কিছু কিছু গাছ যে বহু পুরোনো...তা তাদের দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর মোটা মোটা ঝুরি দেখেই বুঝতে পারলাম....তাহলে ফেয়ারি টেলের মত সাজানো গোছানো ইসপ্যামার ভিতরে এরকম একটা অদ্ভুত জায়গাও আছে!!
হঠাৎ মিট্টি....'স্রোত!!!'....বলেই আমার হাত চেপে ধরলো.... আমি দেখলাম আমাদের ঠিক আগে থাকা প্যাম,সুজী আর সমীরও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে.. আর আমাদের বেশ কিছুটা আগে এগিয়ে থাকা ডাইকো....আর রিজ্ ও
আমাদের থেকে অল্প একটু দূরেই একটা বিশাল গাছের নীচে বেশ কিছু অবয়ব দেখা যাচ্ছে... আমি আর একটু ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম....আর....আর আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম
আমাদের কারোরই রাতে দেখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না...তাই স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম...একটা শুয়ে থাকা শরীর কে ঘিরে তিনটে অদ্ভুত অবয়ব উপুড় হয়ে ঝুঁকে রয়েছে...শুয়ে থাকা শরীরটার লাল রঙের জুতো পরা পা দুটো বেরিয়ে আছে...আর কিছু দেখা যাচ্ছে না....
হঠাৎই 'সানাআআআআ' বলে একটা বিকট চীৎকার করে তীরের মতো ছুটে গেল রিজ্...আর তার পিছনে ডাইকো...
প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে আমরাও ছুট দিলাম....আর নিমেষের মধ্যে অবয়বগুলোর প্রায় দু'হাতের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম...আর....
কী??!!!কী ওগুলো...!!!! মানুষের মতো দুটো হাত দুটো পা,মাথা সব আছে... কিন্তু কিন্তু...
সংখ্যায় ওগুলো তিনটে.....তার মধ্যে দুটো মেয়ের মত মনে হোলো...কারণ লম্বা লম্বা জটপাকানো চুল মুখের সামনে ঝুলে পড়েছে.... ছেঁড়াখোড়া ময়লা ড্রেস পরে আছে....ড্রেসগুলো আমাদের মতোই ছিল কোনো এককালে.. কিন্তু এখন ধুলোমলিন এবং মাটি মাখা...ওরা ঝুঁকে আছে একটা ছোট্ট শরীরের উপর..আর সেই ছোট্ট শরীরটা যে রিজের আদরের বোন রুকসানা ছাড়া আর কারোর নয়...তা আমাদের আর বুঝতে বাকি নেই..…
মূর্তি গুলো রুকসানার জ্ঞানহীন শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে ওর শরীর টাকে টিপে শুঁকে দেখছে...আর ওদের মুখ থেকে গররর্ গররর্ ধরণের একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসছে...একটা মূর্তি হঠাৎ রুকসানার পায়ের খোলা অংশ টা জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করলো....
"এই...এই...তোরা কে রে!!!কি করছিস তোরা আমার বোনকে নিয়ে"...
চীৎকার করতে করতে ওদের দিকে ছুটে গেল রিজ্...আর যে অদ্ভুত মেয়েটা রুকসানার খোলা পা টা ওর বিশাল লম্বা জিভটা দিয়ে চাটছিল....তার চুলের মুঠিটা ধরে রুকসানার উপর ঝুঁকে পড়া ওর শরীরটা টেনে সরানোর চেষ্টা করলো... কিন্তু পুরোটা পারলো না...তবে মূর্তি টা ওর টানে মুখটা উপর দিকে তুললো...আর আমরা দেখলাম...ওর চোখের পুরো অংশটাই কালো...আর লালাঝরা মুখের দুপাশ দিয়ে কুকুরের মতো দুটো দাঁত বেরিয়ে রয়েছে....কয়েক মুহূর্ত...ঐ অদ্ভুত প্রানীটা নাকি মেয়েটা আমাদের দিকে দেখলো...তারপর বিদ্যুতের মতো উঠে দাঁড়িয়ে....দাঁত খিঁচিয়ে পাগল কুকুরের মতো গরগর করতে করতে রিজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো....আর বাকি দুটো মূর্তিও বিদ্যুৎগতিতে আমাদের দিকে তেড়ে এল.....আর ওদের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা ডাইকো আর সমীরের উপর একটা বুনো জন্তুর মতো চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো.....
হঠাৎ আমার পাশে একটা থপ করে আওয়াজ পেলাম... তাকিয়ে দেখলাম প্যাম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে.....
0 Comments.