Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ১)

maro news
ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প - ১)

মফস্বলী

শহর‌ও নয়, গ্রাম‌ও নয়। হয়ত গ্রাম আর শহরের মাঝে একটা হাইফেন। 'শহরতলি' শব্দটা তো হালফিলের। শীর্ষেন্দুর লেখায় গঞ্জ, একটু শহরঘেঁষা, তো মফস্বল। এরকমই এক গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের মফস্বলের কথা বলেই গল্প শুরু করা যাক। 'গঙ্গার পশ্চিম কূল বারাণসী সমতুল'-- এ হেন পশ্চিমকূলেই কোথাও কালীমন্দির স্হাপনের জন্য জমি খুঁজেছিলেন রানী রাসমণি। জমি তো পেলেন উল্টোদিকে, আর পশ্চিম দিকের মানুষ পেল জ্ঞান হতে না হতেই গঙ্গার ধারে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির এর দর্শন। দু'দশক আগেও গঙ্গার ধারের এই মফস্বল শহরগুলো কলকাতার এত কাছে হয়েও শহর থেকে অনেকটাই আলাদা। গঙ্গা এদের শিরা, ধমনী। আর তার দুই ধারে অজস্র গাছের সারি, কলকারখানার খাঁজকাটা পাঁচিল আর লাল ইঁটের মন্দির।আর তার মধ্যেই জীবনের রোজনামচা। আমরা, যারা আজ ত্রিশের কোঠায়, তাদের শৈশব ও কৈশোরের বেশিটাই কেটেছে এরকমই কোন মফস্বলে। সে সময়টা নব্বইয়ের দশক, পরিবার বলতেও তখন পাড়াসুদ্ধু লোককেই বোঝাত। আর আমরা ছিলাম সেখানেই মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো, এককথায় পাড়াবেড়ানো ছেলেমেয়ে। আনন্দের অভাব ছিল না, শাসন‌ও ছিল জোরদার।তবে এর মধ্যেই আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করি শহর মফস্বলের পার্থক‍্য, তাই আজ যতই নিজেদের শিকড় নিয়ে উৎসাহী হ‌ই না কেন স্কুল কলেজ চলাকালীন মফস্বল নিয়ে এরকম নস্টালজিয়া তো ছিল‌ই না, বরং শহরে না থাকায় একটা হালকা হীনমন্যতা কাজ করত। খুব ছোট বয়সেই শিশুমন বুঝেছিল 'I live in' আর 'I live at' এর পার্থক্য। শতচেষ্টা করলেও নিজের থাকার জায়গার আগে in বসানো যাবে না, ভেতরে ভেতরে কষ্ট দিত এই অনিবার্যতা। আরো বড় হয়ে, বিশেষত কলেজে পড়ার সময় বাড়ি ফেরার তাড়া বিরক্ত করত, যাতায়াতের বিড়ম্বনা, আশেপাশের মানুষের বাড়তি নাক গলানো অসহ্য লাগত বয়োধর্মেই। অন‍্য দিকে শহুরে সহপাঠীদের স্বাধীনতা, অনায়াসত্ব কষ্ট দিত। আর সব কিছুর জন্যে দায়ী হত সেই মফস্বল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের সাথে বন্ধুত্ব হল, অনেক বেশি কাছাকাছি এলাম। কিন্তু তার থেকেও অদ্ভুতভাবে নিজের ছোট্ট মফস্বলের প্রতি বিরাগ বদলে গেল অনুরাগে। এই অনুরাগের উৎস ঠিক কোথায় তা সঠিকভাবে বলতে পারব কিনা জানিনা, তবে হয়ত এমন একটা ছোটবেলা উপহার দেওয়ার জন্য, যার মূল্য তখন বুঝিনি। হয়ত সেই নরম আলো মাখা প‍্যাস্টেলরঙা সকালগুলোর জন্য যখন মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বন্ধুরা মর্ণিং ওয়াকে যেতাম। হয়ত সেই রেনি ডে যা একটা হঠাৎ ছুটির পাশাপাশি বৃষ্টি ভেজার স্বাধীনতাও নিয়ে আসত। অথবা গঙ্গার ঘাটে বন্ধুদের জমায়েত, আড্ডা, চেনা কাকু বা দাদার হাতের অসাধারণ চুরমুর, ফুচকা, তেলেভাজা বা পাপড়ি চাট। বা সাইকেল নিয়ে সারাদিন টিউশন পড়ার নামে ঘুরে বেড়ানো। এরকম অনেক ছোটছোট স্মৃতির ভিড় এককালের হীনমন্যতাকে যে কবে উড়িয়ে দিয়েছে, আজ তা মনেও নেই। যদি কিছু মনে থাকে তবে তা একরাশ নব্বই দশকের গল্প, মোবাইল, ইন্টারনেট যুগের আগে। হয়ত এ লেখা, সেই মফস্বলের, নিজের শিকড়ের ঋণ বা পিতৃপিতামহ-পিতামহীর ঋণ শোধ করার জন্য, বা হয়ত সেই মুহূর্ত গুলো আর একবার নতুনভাবে বাঁচার জন্য। হয়ত নিজেকে বোঝানোর জন্য যে শহর আর মফস্বল দুজনকেই ভালবাসা যায়। তফাৎ টা খালি মা আর প্রেমাস্পদের। মফস্বল আমার মতো অনেকের শৈশব আর কৈশোরকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে, সে মণিমুক্তোর ভান্ডার আজও একান্ত নিজস্ব।

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register